নুরুল আমিন কাসমী
জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী জুবিন গার্গের হঠাৎ মৃত্যুসংবাদে সমগ্র আসামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চল স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। শুধু তাঁর ভক্তরা নয়, সাধারণ মানুষ, শিল্পীসমাজ, এমনকি রাজনৈতিক মহল পর্যন্ত শোকের ছায়ায় আচ্ছন্ন। সামাজিক মাধ্যমে ভেসে আসছে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, স্মৃতি আর অশ্রুসম্ভার। তাঁর প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে তাঁর সৃষ্টিকর্ম ও জীবনদর্শনের নতুন করে মূল্যায়ন। জুবিন গার্গ প্রায় ৪০টি বিভিন্ন ভাষায় ৩৮ হাজারেরও বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন—যা নিজেই এক ইতিহাস। এটি সবার পক্ষেই সম্ভব নয়। শুধু গানে কণ্ঠ দেওয়াই নয়, তিনি নিজেই বহু গান লিখেছেন, সুর করেছেন এবং কণ্ঠ দিয়েছেন। তাঁর সাবলীল ও হৃদয়স্পর্শী গানের রচনাগুলি সাধারণ মানুষ যে কত গভীরভাবে ভালোবাসত, তার প্রমাণ ইতিমধ্যেই তাঁর মৃত্যুর পর পাওয়া গেছে।
মহান এই শিল্পীর জীবনব্যাপী সাধনার পূর্ণ মূল্যায়ন করা এই ক্ষুদ্র লেখায় সম্ভব নয়। তবে তাঁর গানগুলির এক বিশেষ দিক নিয়ে এখানে আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। জুবিন গার্গের গানে প্রেম, বেদনা, প্রকৃতি, বিদ্রোহ, ধর্মীয় অনুভূতি ও দেশপ্রেমের পাশাপাশি এক বিশেষ আধ্যাত্মিক সুর ধরা পড়ে।
জুবিন গরগের গাওয়া 'ইয়া আলি' হিন্দি গানে অভিনয় করার একটি দৃশ্য
তাঁর বহু গানে সাধারণ জীবনদর্শনের সঙ্গে সুফিবাদের আধ্যাত্মিক ভাবধারা গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। অর্থাৎ, তাঁর গানে আধ্যাত্মিকতা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। সুফিবাদ এমন এক দর্শন, যেখানে পার্থিব জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মৃত্যুর পরের জীবনকেই প্রকৃত সত্য বলে মনে করা হয়। আল্লাহ বা ঈশ্বরের সৃষ্টিকে নিজের অংশ বলে জানা এবং সমস্ত জীবের সঙ্গে প্রেম স্থাপন করা এই দর্শনের মূল শিক্ষা।
‘সুফি’ শব্দটি আরবি হলেও, এটি বিশ্বসাহিত্য ও কলার এক জনপ্রিয় বিষয়। এখানে সুফির অর্থ সাধক বা আধ্যাত্মিক গুরু, আর আধ্যাত্মিকতা প্রতিটি ধর্মের মূল সত্তা। জনপ্রিয় তারকা হয়েও, জুবিন গার্গের জীবন অন্য তারকাদের থেকে একেবারেই আলাদা ছিল। তিনি ছিলেন এক প্রকৃত সাধক। পার্থিব জীবনের কোনো বস্তু বা মোহে তিনি আবদ্ধ ছিলেন না।
তাঁর বহু গানে মৃত্যুকে জীবনের চরম সত্য হিসেবে প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। সাক্ষাৎকার ও আলোচনাতেও তিনি বারবার এই কথাটি ব্যক্ত করেছেন। মানবপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেমের পাশাপাশি মৃত্যুকেও তিনি যেন এক বন্ধুর মতো ভালোবাসতে শিখেছিলেন, যা তাঁর এই গানের মাধ্যমে বোঝা যায়:
“মই নথকার অনুভব
যিদিনা হ'ব তোমার
সিদিনা অশ্ৰু নিগরিবনে কোয়া...”
এই গানে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, এই পৃথিবীতে কিছুই স্থায়ী নয়; সবাই একদিন খালি হাতেই এই মায়াময় পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। তাঁর বহু গানে তিনি বারবার তাঁর ভক্তদের সেই সত্য উপলব্ধি করাতে চেয়েছেন। ধন-সম্পদের লোভে, ক্ষমতার মোহে মানুষে মানুষে যে অন্যায়-অত্যাচার করছে, রাজনীতি ও সমাজের যে অন্যায্য কাঠামো তৈরি হয়েছে, তা নিয়েও তিনি প্রতিবাদ করেছেন তাঁর গানে:
“এই মায়ার ধরাত...
দুদিন মাথোঁ থাকিবা তুমি।
নিবলে একোকে নাপাবা তুমি
তোমারো যি সপোন আমারো সপোন
সপোনরে চিলোয়া উদর
দুখন হাতর মুঠিত একেই সমান মাটি
সাজিবলে একেই কবর...
লোয়া লোয়া আরু লোয়া
খোয়া খোয়া আরু খোয়া
একো নাই....
মারা মারা আরু মারা
চেপি চেপি তেজ খোয়া
শূন্য হায়..!”
যদিও মৃত্যু চিরন্তন সত্য, তবুও মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায়। কেউই মরতে চায় না, বরং শত বছর বাঁচার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। যেমন, মাইকেল জ্যাকসনের মতো তারকা ১৫০ বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন।
একটি অনুষ্ঠানে জুবিন গর্গের গীত পরিবেশন করার দৃশ্য
কিন্তু জুবিন গার্গ ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি প্রায়ই বলতেন, “জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই; কে জানে আমি কখন মারা যাবো!” এই দেহের কোনো ভরসা নেই, এই কথাটি তিনি তাঁর এই গানের মাধ্যমে মানুষকে মনে করিয়ে দিতেন:
“দেহর ভরষা নাই বুজিছানে নাই
আজি হাঁহি আছো ক'বতো নোয়াৰো
কালি বা কি আছে হায়, কপালতে
কালি বা কি আছে হায়...
মই মরিম যিদিনা ঐ..
একেডাল বাহকে তিনিচেও করিব..
মাজর চেও কঁচালির কামি,
চারিজন মানুহে কান্ধত তুলি নিব
নৈর ঘাটলৈ বুলি..।”
এই গানে তিনি দেখিয়েছেন, মৃত্যু যে কোনো মুহূর্তে আসতে পারে, তাই পার্থিব দেহ ও ধনসম্পত্তির উপর নির্ভর না করে ঈশ্বরের সৃষ্টিকুলের সঙ্গে ভালো আচরণ করে আধ্যাত্মিক জীবনের পথে চলা উচিত। মৃত ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার পরিবারের অবস্থাও তিনি হৃদয়স্পর্শীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।
তাঁর বিখ্যাত সুফি গানের পংক্তি:
“ইয়া আলি মদদ ওয়ালি
ইয়া আলি... ইয়ার পে কুরবান হে চভি,
ইশ্ক পে মিটা দুঁ
মে আপনী খুদী,
ইয়া আলি...”
এই গানটি একটি সুফি সঙ্গীত হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাত। এখানে “ইয়ার” শব্দটি বন্ধু, সহযাত্রী বা প্রিয়জন অর্থে ব্যবহৃত হলেও, প্রকৃত অর্থে তা ঈশ্বর বা আল্লাহকেই নির্দেশ করে। প্রকৃত সাধক তাঁর ঈশ্বরকেই বন্ধুরূপে গ্রহণ করেন এবং শেষে সেই প্রিয়ের মধ্যেই বিলীন হয়ে যান।
জুবিন গার্গ মৃত্যুকেও এক ধরনের শিল্প বলে মনে করতেন। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি মৃত্যুকে ভয় না করে বরং তাকে প্রশ্ন করেছেন:
“মৃত্যু যদি শিল্প হয়...
মৃত্যু কিদরে সুলভ?
মৃত্যু যে এতিয়া সহজ...”
ক্ষমতালোভী রাজনীতি ও সমাজের অন্ধ শাসন ব্যবস্থার সমালোচনা করে তিনি মানুষকে মায়া ও লোভ থেকে মুক্ত হয়ে মৃত্যুর সত্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন:
“অন্ধ শাসন ভণ্ড শাসক
অৰ্থ লোভর নগ্ন যুঁজত
জীবন মরণর স্বপ্ন বাহক
মগ্ন বিভোর অন্ধ সুখত
মুকুতি আজি দেখো
দিশহারা হৈ রয়
দিশে দিশে চলে মাথো মৃত্যুর জয়
মৃত্যু এতিয়া সহজ।”
শেষে, মৃত্যুর দিন তাঁর জন্য কেউ যেন না কাঁদে, এই আহ্বান জানিয়ে তিনি গেয়েছিলেন:
“মোর মৃত্যু দিনা তুমি আহিবা
তুমি পিছে নাকান্দিবা
তুমি পিছে নাকান্দিবা...”
এই অনুভূতিগুলো লেখকের নিজস্ব উপলব্ধি। সবাই হয়তো একমত নাও হতে পারেন। তবে, হাজার ভক্তের প্রিয় তারকা হয়েও, জুবিন গার্গের সাধারণ জীবনযাপন এই ভাবনার সত্যতাকে প্রমাণ করে। তাঁর নিজের অভিনীত এক গানে সুফিতত্ত্বের আরও এক উজ্জ্বল প্রকাশ পাওয়া যায়:
“ইশ্ক নামাজী/
ইশ্ক হে কাবা
করলে ইশ্ক কা সজদা...”
সুফি সাধকদের জীবনের মূল শিক্ষা, জাতি ও ধর্মের বিভেদ ভুলে, শিল্প ও সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষকে জীবনের চিরন্তন সত্য উপলব্ধি করানো। মহান শিল্পী জুবিন গার্গ তাঁর জীবন ও গানের মাধ্যমে আমাদের সেই শিক্ষা দিয়ে গেছেন।
জুবিন গার্গ
এই লেখাটি কেবল কিছু উদাহরণ মাত্র। তাঁর গানসম্ভারের গভীরে ডুব দিলে আরও বহু উদাহরণ পাওয়া যাবে, যা ভবিষ্যতে গবেষণার বিষয় হবে নিঃসন্দেহে। আমি নিজে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের “সুফীতত্ত্ববাদ” (Sufism) বিষয়ে এক জন গবেষক ছাত্র হিসেবে এই অনুভবগুলো লিখেছি। মতভেদ থাকতেই পারে। তবে, জুবিনদার আদর্শ ও সঙ্গীতচেতনা আমাদের মাঝে চিরদিন বেঁচে থাকুক, এই কামনাই করি।
(লেখক: তেজপুরস্থ Islamic Study & Research Academy, Assam-এর সভাপতি)