অসমের দুই অমর কণ্ঠের স্মৃতিতে বয়ে চলেছে ব্রহ্মপুত্র

Story by  Pallab Bhattacharyya | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 11 d ago
জুবিন গার্গ এবং ভূপেন হাজরিকা দুজনেই সংগীত জগতের অমর নাম
জুবিন গার্গ এবং ভূপেন হাজরিকা দুজনেই সংগীত জগতের অমর নাম

    পল্লব ভট্টাচাৰ্য্য

 
২০১১ সালের ৫ই নভেম্বর ‘সুধাকণ্ঠ’ ড. ভূপেন হাজরিকার মৃত্যুর মাধ্যমে অসমের আত্মার পরিচয়দানকারী একটি যুগের অবসান ঘটেছিল। ‘ব্রহ্মপুত্রের পাখি’ হিসেবে খ্যাত ভূপেন হাজরিকার সংগীত এক দশকের রাজনৈতিক অস্থিরতা, আশা ও নবত্বের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর বহন করেছিল। তিনি শুধুমাত্র একজন গায়ক বা সুরকারই ছিলেন না, বরং অসমবাসীর আবেগের মূর্ত প্রতীক ছিলেন।

২০১৯ সালে মৃত্যুর পর ভূপেন হাজরিকাকে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘ভারত রত্ন’ প্রদান করা হয়। তাঁর সৃষ্টিশীল প্রতিভা দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তবে এই স্বর্ণযাত্রা সহজ ছিল না—আদর্শগত মতভেদের কারণে কখনও তাঁকে বহিষ্কৃত হতে হয়েছে, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করতেও বাধ্য হতে হয়েছে, আর কাঙ্ক্ষিত সৃষ্টিশীল স্বাধীনতার সন্ধানে তাঁকে কলকাতা এবং পরে মুম্বাইতে স্থানান্তরিত হতে হয়।

তাঁর মৃত্যুর সময় শুধু অসম নয়, গোটা দেশেই গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। গৌহাটির রাজপথে আধা মিলিয়নেরও বেশি মানুষ সমবেত হয়েছিল, লক্ষ লক্ষ মানুষ দূর থেকে ভূপেন হাজরিকার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছিল এবং অসম যেন তার কণ্ঠ হারানোর শোক প্রকাশ করেছিল। তাঁর শেষকৃত্য ছিল ভারতের অন্যতম বৃহত্তম জনসমাগমপূর্ণ বিদায় অনুষ্ঠান।
 

 
চিরনিদ্রায় সুধাকণ্ঠ ভূপেন হাজরিকা

কিন্তু ২০২৫ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর, যখন আধুনিক অসমীয়া তরুণ প্রজন্মের হৃদস্পন্দন, গায়ক, সুরকার ও অভিনেতা জুবিন গার্গ ৫২ বছর বয়সে সিঙ্গাপুরে হঠাৎ করে প্রয়াত হন, তখন রাজ্যে এমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় যা আগে কখনও দেখা যায়নি।
 
প্রাণের শিল্পী জুবিনকে হারিয়ে গোটা অসম শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে। প্রায় ১৫ লাখ শোকাহত মানুষ গৌহাটির রাজপথে জমায়েত হয়। দুবাইয়ের প্রবাসী অসমীয়া থেকে শুরু করে লন্ডন ও করাচির শিল্পীরা পর্যন্ত, বিশ্বজুড়ে নানা প্রান্ত থেকে মানুষ জুবিন গার্গকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করে।
 
সোশ্যাল মিডিয়ার টাইমলাইনগুলো কান্নায় ভেসে যায়, এবং আশ্চর্যের বিষয়, এই শোক এখনও অব্যাহত আছে। লিমকা বুক অফ রেকর্ডস ইতিমধ্যেই একে এশিয়ার সবচেয়ে বড় জনসমাগমপূর্ণ বিদায় অনুষ্ঠান হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।

এখানেই প্রশ্ন ওঠে—জুবিনের মৃত্যুই কেন এমন অসাধারণ আবেগ সৃষ্টি করল? সেইসঙ্গে, এই দুঃখ ও শোকের সময়ে কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন: জুবিন গার্গ কি ভূপেন হাজরিকার থেকেও বড় শিল্পী? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য শুধু সংগীত নয়, সময়ের প্রসঙ্গও বিবেচনায় আনতে হবে—কীভাবে প্রজন্ম বদলায়, কীভাবে প্রযুক্তি শোকের অভিজ্ঞতা ও প্রকাশকে রূপান্তরিত করে, আর কীভাবে অসমের জনমানসে প্রতিটি হৃদস্পন্দনের সঙ্গে অসমীয়ার পরিচয় নতুন করে বিকশিত হয়।
 
শেষ বিদায় জুবিনকে, রাজপথে জনতার ঢল

ভূপেন হাজারিকার সেই সময়ের কথা, যখন শিল্প ছিল এক প্রতিষ্ঠান, এক সামূহিক জাগরণের মাধ্যম। তাঁর সংগীত উদ্ভূত হয়েছিল ব্রহ্মপুত্রের বুক থেকে, যা ছিল লোকপরম্পরা, রাজনৈতিক চেতনা এবং নৈতিক দর্শনে পরিপূর্ণ। তিনি পাহাড় ও সমতলের মধ্যে, অসমিয়া ও ভারতীয়ের মধ্যে, কবিতা ও প্রতিবাদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেছিলেন।
 
তাঁর খ্যাতি অর্জিত হয়েছিল কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে; তাঁর ছিল বিশ্বব্যাপী প্রভাব। তবুও তাঁর জনসমক্ষে উপস্থিতি ছিল অনেক বেশি গম্ভীর ও মর্যাদাপূর্ণ। অপরদিকে, জুবিন গার্গের সাধারণ মানুষের সঙ্গে ছিল তাৎক্ষণিক সংযোগ। আধুনিক আসামের সন্তান হিসেবে ১৯৯২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর প্রথম অ্যালবাম ‘অনামিকা’ বিদ্রোহ ও স্বকীয়তার মধ্যে সংগ্রামরত এক প্রজন্মকে দিয়েছিল একটি শক্তিশালী কণ্ঠস্বর।

তিনি কোনও বিচ্ছিন্ন আইকন ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সঙ্গপ্রিয় মানুষ। তিনি তাঁর অনুরাগীদের সঙ্গে ইনস্টাগ্রামে কথা বলতেন, সংকটকালে তাঁদের সহায়তা করতেন, অচেনা মানুষের হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতেন, এবং বন্যা সাহায্য থেকে শুরু করে পরিবেশ সংরক্ষণ পর্যন্ত বিভিন্ন কারণে মানুষের পাশে দাঁড়াতেন।

সংগীত জগতে তিনি ৪০টি ভাষায় ৩৮,০০০-এরও বেশি গান গেয়েছেন, কিন্তু এই সংখ্যার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল মানুষের সঙ্গে জুবিনের সান্নিধ্য। ভূপেন হাজারিকার সময়ে দর্শকরা শিল্পীদের সম্মান করত; জুবিনের সময়ে শ্রোতারা তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব করত। এবং এই বদলটাই সবকিছু পাল্টে দিয়েছে।

২০১১ সালে বিশ্ব যখন সোশ্যাল মিডিয়াকে বুঝতে শুরু করল, ২০২৫ সালে এসে তা বিশ্বজুড়ে অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। জুবিনের মৃত্যুর ঘটনাটি বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ মোবাইলের স্ক্রিনে সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছে।
 
জুবিনক শ্ৰদ্ধা নিবেদন কৰিছে মুখ্যমন্ত্ৰী হিমন্ত বিশ্ব শৰ্মা

অনুরাগীরা তাঁর শেষ বার্তাগুলো শেয়ার করছে, তাঁর শেষ কনসার্টের ভিডিও বারবার দেখছে, এবং সীমান্ত পেরিয়ে চারদিকে একটি ভার্চুয়াল জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি অসমীয়া ঘর, প্রতিটি অনলাইন কমিউনিটি এক বিশাল, সামূহিক শোকগাথার অংশ হয়ে উঠেছিল। মানুষ তাদের আবেগ-অনুভূতি প্রতিটি মুহূর্তে সমষ্টিগত মঞ্চে প্রকাশ করার এই সময়ে জুবিনের মৃত্যুর সংবাদ জনসাধারণের দুঃখকে দ্বিগুণ করে।

সুতরাং, ভূপেন হাজরিকা বা জুবিন গার্গকে কতজন ভালোবাসেছিল—এতে কোনো পার্থক্য নেই, তবে সেই ভালোবাসা কীভাবে প্রকাশ করা হয়, তাতই পার্থক্য আছে। একজনের জন্য নীরবতা ও গম্ভীরতার মধ্যে শোক প্রকাশ করা হয়েছে; অন্যজনের জন্য ডিজিটাল জগতের কোটি কোটি মানুষের শোক এবং ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, যা শেষ হওয়ার কোনো নাম নেই।

এই দুইজনকে তুলনা করাটা হল শিল্পের প্রকৃতিকে ভুল বোঝা। হাজরিকা অসমের সংগীতকে একটি সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা প্রদান করেছিলেন এবং এটি বিশ্বজুড়ে প্রচার করেছিলেন।

জুবিন ছিলেন এক সাংস্কৃতিক সেতু—তিনি সেই পরিচয়কে আধুনিক ধারার মধ্য দিয়ে মুক্তভাবে প্রবাহিত করেছিলেন এবং স্বকীয়তা হারানো ছাড়াই বৈশ্বিক সংগীতকে অসমে নিয়ে এসেছিলেন। যদি হাজরিকা অসমীয়াদের সম্মানের স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছিলেন, জুবিন তাদের সম্মানের স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছিলেন।
 
কফিনের মধ্যে জুবিনকে শেষবারের মতো দেখছেন স্ত্রী গরিমা গার্গ এবং তাঁর আত্মীয়জনরা

জুবিনের মৃত্যুতে চারদিকে দেখা শোক তাঁর শ্রেষ্ঠতার প্রমাণ নয়, এটি সময়ের আয়না। হাজৰিকার প্রজন্ম সংযমকে সম্মান করে, জুবিন আবেগিক সততাকে সম্মান করে। তাঁর আকস্মিক মৃত্যু, যৌবনের জীবন্ততা, এবং অনলাইন জগতের তাৎক্ষণিকতা শোককে একটি আন্দোলনে পরিণত করেছে।

জুবিনের মৃত্যু সাংস্কৃতিক জগতকে একটি গভীর শিক্ষা দিয়েছে। এটি সাংস্কৃতিক গণতন্ত্রের উত্থান প্রকাশ করে, যেখানে একজন শিল্পীর প্রতি প্রেমের জন্য প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বা রাষ্ট্রের স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই। এটি মানুষ থেকে মানুষে অবাধে প্রবাহিত হয়। এটি শিল্পকর্মে আবেগিক প্রামাণিকতার ক্রমবর্ধমান চাহিদার ওপর আলোকপাত করে।

আজকালকার ভক্তরা তাদের নায়কদের নিজেদের কাছে রাখতে চায়, ভুল-ত্রুটিতে ভরা আত্মীয় হিসাবে। প্রবাসী ভারতীয়, ডিজিটাল মিডিয়া এবং আন্তর্জাতিক শ্রদ্ধাঞ্জলির মাধ্যমে স্থানীয় দুঃখকে বিশ্বব্যাপী সংহতিতে রূপান্তর করে অসমীয়া পরিচয়ের বিশ্বায়নের প্রসঙ্গ এখানে তুলে ধরা হয়েছে।

অতএব ভবিষ্যত হবে তাদের, যারা জুবিনের মতো শিল্প এবং মানবিকতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে, উৎকর্ষতা এবং সহানুভূতির মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে পারে। তারা শুধু গান গাইবে না, তাদের সংগ্রামের সঙ্গে থাকবে, তারা উদযাপিত আত্মার সঙ্গে যুক্ত থাকবে।

প্রাণের শিল্পী জুবিন গার্গের শেষকৃত্যের অসহ্য মুহূর্ত

অমর কণ্ঠ ভূপেন হাজৰিকা এবং কিংবদন্তি জুবিন গার্গের গল্প প্রকাশ করে যে, তারা রেখে যাওয়া অর্থেই মহানতা মাপা হয়। একজন অসমকে সংগীতের ব্যাকরণ দিলেন, অন্যজন হৃদয়ের জন্য ছন্দ দিলেন। একজন দলং নির্মাণ করলেন, অন্যজন নিজের লোকদের সঙ্গে হাতে হাত ধরা দিয়ে সেই দলং পার হয়ে গেলেন। আজ অসম শুধু একজন শিল্পীকে হারানোর জন্য শোক প্রকাশ করছে না, বরং এক যুগান্তকারী বন্ধুত্বের সমাপ্তির জন্যও শোক প্রকাশ করছে।

তবুও, সেই দুঃখের মাঝেও নতুনত্ব লুকিয়ে আছে। যতদিন তাদের গান গাওয়া হবে, ততদিন ব্রহ্মপুত্র তাদের কণ্ঠস্বর যুগ যুগ ধরে বহন করবে। প্রকৃতপক্ষে ভূপেন হাজৰিকা বা জুবিন গার্গের মৃত্যু হয়নি। তারা অসমের শ্বাস-প্রশ্বাসের ধরণ বদলে দিয়েছেন। তাদের সংগীত চিরন্তন প্রতিধ্বনিত হয়ে থাকবে, যেখানে প্রেমের মতো প্রকৃত কলা কখনো হারায় না। এটি কেবলমাত্র পরিবর্তন।
 

(লেখক: অসম সরকারের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক তথা অসম লোকসেবা আয়োগের প্রাক্তন অধ্যক্ষ এবং 'আওয়াজ-দ্য ভয়েস অসম'র প্রধান কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা)