শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ
দীপান্বিতা অমাবস্যা মানেই মা কালীর আরাধনার দিন। এই বিশেষ তিথি ঘিরে প্রতিবছর যেমন হাজার হাজার ভক্ত ভিড় জমায় তারাপীঠে, তেমনি এ বছরও সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেছে বীরভূমের এই তন্ত্রপীঠ। দীপাবলি ও কালীপুজো উপলক্ষে ইতিমধ্যেই তারাপীঠের মা তারার মন্দির চত্বর সেজে উঠেছে আলোকসজ্জা ও ফুলে ফুলে।
মন্দির কমিটির সভাপতি তারাময় মুখোপাধ্যায় জানান, এই বছর অমাবস্যা তিথি শুরু হচ্ছে ২০ অক্টোবর দুপুর ২টা ৫৭ মিনিটে এবং শেষ হবে ২১ অক্টোবর বিকেল ৪টা ২৬ মিনিটে। অমাবস্যা শুরু হতেই তারাপীঠে মা তারাকে কালী রূপে পূজা করা হবে। “আমাদের পুজো নিশীথ কালে শুরু হয়,” বলেন তিনি, “রাত ১০টা ৩০ মিনিট থেকে ১১টার মধ্যে মায়ের নিশীথ পুজো শুরু হবে। সেই সময় মা-কে সাজানো হবে রাজরাজেশ্বরী রূপে—সোনার গয়না, ফুলের মালা, রেশমি বস্ত্র, আর প্রদীপের আলোয় আলোকিত হবে সমগ্র মন্দির চত্বর।”
কালীপুজোর রাতে ভক্তদের ভিড়ে কার্যত উপচে পড়ে মন্দির প্রাঙ্গণ। অমাবস্যা লাগার পর থেকেই মন্দির থেকে মহাশ্মশান পর্যন্ত দীর্ঘ ভক্তসমাবেশ দেখা যায়। সন্ধ্যারতির পর মায়ের শীতল ভোগ নিবেদন করা হয়, তারপর ভক্তদের জন্য আবার খুলে দেওয়া হয় মন্দিরের দরজা। সেই সময় আশেপাশের সেবাইত পরিবারের মহিলারা মাটির প্রদীপ হাতে মন্দির থেকে শ্মশান পর্যন্ত সারি সারি আলো জ্বালিয়ে সাজিয়ে তোলেন গোটা এলাকা। আধুনিক আলোর ঝলকানির পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী প্রদীপের আলোয় দীপ্ত হয়ে ওঠে তারাপীঠ।
পুজোর মূল আকর্ষণের মধ্যে অন্যতম ‘শ্যামা সঙ্গীত’। মন্দিরের সেবাইত পরিবারের মেয়েরা ও স্থানীয় মহিলারা সন্ধ্যারতির পর মা কালীর উদ্দেশ্যে আধঘণ্টা ধরে শ্যামা সঙ্গীত পরিবেশন করেন, যা দেখতে ভক্তদের ভিড় হয় বিপুল। এই সময় তারাপীঠের তন্ত্রপীঠ চত্ত্বরে চলে হোমযজ্ঞ ও তন্ত্রমতে পূজা। সাধক-তান্ত্রিকরা আসেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে সাধনা করতে। একদিকে মহাশ্মশানে শবদাহ, অন্যদিকে সাধনার অনুষ্ঠান — এই বিরল দৃশ্যই তারাপীঠকে করে তোলে বিশেষ।
তন্ত্রপীঠ তারাপীঠে কালী মায়ের মূর্তি
মায়ের ভোগ নিয়েও থাকে বিস্তর আয়োজন। নিশীথ পুজোর পর মাকে নিবেদন করা হয় খিচুড়ি, বলি দেওয়া পাঁঠার মাংস, মাছ, কারণবারি, পোলাও, পাঁচরকম ভাজা, চাটনি, পায়েস ও মিষ্টি। সন্ধ্যারতির পর ‘শীতল ভোগ’-এ থাকে লুচি, সুজি, বিভিন্ন ভাজা ও নানা প্রকার মিষ্টান্ন। ভক্তরা এই ভোগ পান প্রসাদ রূপে। অনেকে নিজের নাম-গোত্র উল্লেখ করে মায়ের ভোগের খরচও বহন করেন, যা পরে বিলি করা হয় সবার মধ্যে।
অপরদিকে, নিরাপত্তার দিকেও রয়েছে বিশেষ নজর। তারাময় মুখোপাধ্যায় জানান, “কালীপুজোর রাতে গোটা তারাপীঠ এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। মন্দিরের নিজস্ব নিরাপত্তার পাশাপাশি সিসি ক্যামেরা নজরদারি, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও টিআরবিএ-র সদস্যরা সারারাত পাহারায় থাকবেন।” যেহেতু সারারাতই মন্দির খোলা থাকে, তাই নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
তন্ত্রপীঠ তারাপীঠে কালীপুজো মানে শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার নয়, এটি এক গভীর সাধনার রাত্রি। মা তারা ও মা কালীর রূপ একাকার হয়ে যায় নিশীথের অন্ধকারে, প্রদীপের আলোয়, শ্যামা সঙ্গীতে আর ভক্তদের উচ্ছ্বাসে। এইভাবেই দীপান্বিতা অমাবস্যার রাত্রি জুড়ে তারাপীঠ মেতে ওঠে আধ্যাত্মিকতা ও ভক্তির দীপ্তিতে।