অপর্ণা দাস / গুয়াহাটি
হুগলির চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজো আজ কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পুজোর দিনগুলোতে গোটা শহর জুড়ে দেখা যায় এক অনন্য মিলনমেলা, মণ্ডপ নির্মাণ থেকে আলোকসজ্জা, প্রতিমা শোভাযাত্রা থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত, সকল সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে কাজ করেন এই উৎসবকে সফল করে তুলতে। কারও হাতে বিদ্যুতের তার, কারও হাতে তুলি, কেউ সাজাচ্ছেন প্রতিমার প্যান্ডেল, সবাই মিলে এই পুজোকে করে তোলেন এক সত্যিকারের নাগরিক উৎসব।
কিন্তু এই উৎসবের শিকড় কোথায়? কবে থেকে শুরু এই ঐতিহ্য? উত্তর খুঁজতে গেলে ফিরে যেতে হয় প্রায় আড়াইশো বছর আগে, আঠারো শতকের নবাবি আমলে।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় কে দেবের স্বপ্নাদেশের একটি প্রতীকী ছবি
ইতিহাসবিদদের মতে, চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা হয় প্রায় ১৭৫০ সালের দিকে। সেই সময় চন্দননগর ছিল ফরাসি উপনিবেশের অধীনে, আর বাংলার রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল নবাবদের মুর্শিদাবাদ। চন্দননগর তখন, একটি ব্যস্ত বাণিজ্যকেন্দ্র, যেখানে ফরাসি ও নবাবি সংস্কৃতি মিশে তৈরি হচ্ছিল নতুন নাগরিক সমাজ। সেই সমাজে বহু ধনী বাঙালি ব্যবসায়ী, জমিদার ও শিক্ষিত পরিবার নবদ্বীপের রাজপরিবারের অনুগামী ছিলেন। তাঁদের হাত ধরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এই নতুন শাক্ত আরাধনা চন্দননগরে ছড়িয়ে পড়ে।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, যিনি নদিয়ার নবদ্বীপের রাজা ছিলেন, তিনিই প্রথম দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো শুরু করেছিলেন। লোককথা অনুযায়ী, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে দেবী স্বপ্নাদেশ দিয়েছিলেন শক্তির এক নতুন রূপে পুজো আরম্ভ করার জন্য। সেই স্বপ্নাদেশ থেকেই জন্ম হয় দেবী ‘জগদ্ধাত্রী’র, অর্থাৎ ‘জগতের ধারিণী’র। দুর্গার পর দেবীর এই দ্বিতীয় রূপকে কেন্দ্র করেই শুরু হয় এক নতুন শাক্ত উৎসব।
চন্দননগরের বিখ্যাত রানি মায়ের একটি ছবি
পূর্বে উল্লেখ করা মতে, প্রায় ১৭৫০ সালের দিকে প্রথমবার চন্দননগরের কোনো বণিক পরিবার এই পুজো আয়োজন করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শহরের বিভিন্ন মহল্লা, রাজবাড়ি ও বণিক পরিবারও নিজেদের পুজো আরম্ভ করে। ধীরে ধীরে এই পুজো চন্দননগরের নাগরিক উৎসবে পরিণত হয়।
অর্থাৎ বলা যায় নবাবি আমলের সাংস্কৃতিক সহাবস্থান, ফরাসি উপনিবেশের শিল্পরুচি এবং স্থানীয় সমাজের ধর্মীয় উদারতা, এই তিনের মিলিত প্রভাবে জন্ম নেয় চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো, যা আজও ঐক্য, শিল্প ও ভক্তির এক জীবন্ত প্রতীক।
চন্দননগরের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী পুজোর ছবি
বর্তমানেও সেই ঐতিহ্য অটুট। রানি মা, বড় মা, ছোট মা; এইসব নাম আজ চন্দননগরের পুজোর ঐতিহ্যের প্রতীক। প্রতিটি পুজোই প্রায় দুই শতাব্দী পুরনো এবং আজও তাদের প্রাচীন রীতি ও ভক্তির ধারাকে অক্ষুণ্ণ রেখেছে। প্রতিটি পরিবার বা কমিটি তাদের ঐতিহ্য কঠোরভাবে রক্ষা করে এসেছে। প্রতিমার গঠন, অলঙ্কার, সজ্জা, আরাধনা; সবকিছুতেই পুরনো ঐতিহ্যের ছাপ আজও স্পষ্ট।
চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এর আলোকসজ্জা, যাকে স্থানীয়রা বলেন “আলোয় লেখা ইতিহাস”। ফরাসি বিদ্যুৎ প্রকৌশলের প্রভাব ও স্থানীয় কারিগরদের নৈপুণ্যে গড়ে ওঠে এক অনন্য আলোকশিল্পের ধারা, যা আজ বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছে। প্যান্ডেল, দেবীর প্রতিমা, আর বিশাল শোভাযাত্রা; সব মিলিয়ে এই পুজো শুধু ধর্মীয় নয়, বরং চন্দননগরের নাগরিক শিল্পসংস্কৃতির প্রতীক।
চন্দননগরের আলোকসজ্জার একটি ছবি
এই উৎসবের অন্যতম সৌন্দর্য তার ধর্মীয় সম্প্রীতি। চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো এমন এক উৎসব যেখানে ধর্মীয় ভেদাভেদ কখনও স্থান পায়নি। নবাবি আমল থেকেই এখানে হিন্দু ও মুসলমান কারিগর, আলোকশিল্পী ও সংগঠকরা একত্রে পুজোর প্রস্তুতিতে যুক্ত হন। আজও সেই ঐক্যের সংস্কার জীবন্ত, প্যান্ডেল সাজানো থেকে শোভাযাত্রার সংগঠন পর্যন্ত দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে কাজ করেন।
বর্তমানে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছে। দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটক আসে শুধুমাত্র এই আলোকসজ্জা ও কারুকার্য দেখতে। পৌরসভা ও স্থানীয় কমিটিগুলির সমন্বয়ে শহরজুড়ে উৎসবের আবহে মেতে ওঠে লক্ষাধিক মানুষ।
প্যান্ডেল সাজানোর কাজে দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে কাজ করার একটি ছবি (ফাইল)
আজ এই পুজো শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি ইতিহাস, ঐতিহ্য, কারুশিল্প ও সামাজিক সম্প্রীতির এক জ্যান্ত প্রতীক। নবাবি আমলে যে বীজ রোপিত হয়েছিল, আজ তা পরিণত হয়েছে এক মহিমান্বিত সাংস্কৃতিক মহোৎসবে যেখানে ভক্তি, শিল্প ও ঐক্য একসূত্রে গাঁথা। দেবী জগদ্ধাত্রী এখানে শুধু পূজিত দেবতা নন, তিনি এক শহরের প্রাণ, এক সমাজের ঐক্যের প্রতিফলন, আর এক ঐতিহ্যের আলোকবর্তিকা।