ড. সাজিদ হুসেন
জেব আখতার / রাঁচি
এক সফল গবেষণা-জীবনের অধিকারী দক্ষ বিজ্ঞানী ড. সাজিদ হুসেন ঝাড়খণ্ডের রামগড় জেলার চিতরপুর গ্রামের শিশুদের মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য এক ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি ‘স্কুলজিয়াম’ (Schoologium) নামে এক অভিনব উদ্যোগের মাধ্যমে গ্রামীণ শিক্ষার রূপান্তর ঘটিয়েছেন, যা আজ সমগ্র ভারতের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করছে।
ড. সাজিদ বলেন, “যেভাবে আমাদের শরীর সুস্থ রাখতে নিয়মিত ব্যায়াম প্রয়োজন, তেমনই আমাদের মস্তিষ্ককেও সক্রিয় রাখতে নিয়মিত অনুশীলন জরুরি। স্কুলজিয়ামে শিশুরা শুধু পাঠ মুখস্থ করে না; তারা স্পর্শ, স্বাদ, গন্ধ ও বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখার এক অভিনব সুযোগ পায়।”
বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সাজিদ হুসেন
উদাহরণস্বরূপ, অ্যাসিড ও বেস (Acids and Bases) বোঝানোর জন্য তারা লেবু, উচ্ছে ও তরমুজের স্বাদ নেয়। তারা নিজেদের রান্নাঘর থেকে শস্য ও শাকসবজি পরীক্ষা করে পুষ্টি সম্পর্কে শেখে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনের আদর্শের মতোই, এখানে শিক্ষা দেওয়া হয় কল্পনা, সৃজনশীলতা ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।
চিতরপুর গ্রামটি নেমরার প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি ছোট্ট গ্রাম, যেখানে ড. সাজিদ বড় হয়ে ওঠেন। তিনি পড়াশোনা করেন গ্রামের এক সরকারি বিদ্যালয়ে, যেখানে একশোরও বেশি ছাত্রছাত্রী একই শ্রেণিকক্ষে বসত। সেই স্কুল থেকে হাতে গোনা কয়েকজনই জীবনে সফল হতে পেরেছিল, এই অভিজ্ঞতাই তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর তিনি জার্মানিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ন্যাশনাল এরোস্পেস ল্যাবরেটরিতে (NAL) বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করার পর, দেশ-বিদেশের শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে করতে তিনি বুঝতে পারেন, গ্রামের শিশুরা শহরের শিশুদের মতোই মেধাবী; তাদের শুধু সঠিক সুযোগ ও শিক্ষণ-সুবিধার অভাব।
শিক্ষকদের সঙ্গে সাজিদ হুসেনের একটি ছবি
এই বিশ্বাস থেকেই ড. সাজিদ সিদ্ধান্ত নেন যে তাঁর গ্রামের মতো ছোট ছোট গ্রামেও শিশুদের বড় স্বপ্ন দেখা উচিত এবং সেই স্বপ্ন পূরণে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করা উচিত। গ্রামীণ ও শহুরে শিক্ষার মধ্যে ব্যবধান দূর করতে তিনি ২০১২ সালে নিজের নিরাপদ সরকারি চাকরি ছেড়ে গ্রামে ফিরে আসেন। ‘স্কুলজিয়াম’ নামটি এসেছে “School” ও “Gymnasium”-এর সংমিশ্রণ থেকে, এমন এক জায়গা, যেখানে তরুণ মস্তিষ্ক নিয়মিত মানসিক অনুশীলন করে। তাঁর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল শিক্ষকদের মানসিকতা পরিবর্তন করা।
বেশিরভাগ গ্রামীণ অঞ্চলে পড়াশোনা মুখস্থনির্ভর ও পুনরাবৃত্তিমূলক ছিল। নতুন ও ব্যবহারিক শিক্ষণপদ্ধতি চালু করতে মাসের পর মাস প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছিল। এর সমাধানে স্কুলজিয়াম শিশু ও শিক্ষক উভয়কেই প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করে এবং মেকার-ওরিয়েন্টেড পেডাগজি নামে এক নতুন ব্যবহারিক শিক্ষণপদ্ধতির ওপর জোর দেয়, যা সমস্যা সমাধান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতা গড়ে তোলে।
ড. সাজিদের মতে, ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক্স কর্মসংস্থানের নতুন ধারা সৃষ্টি করবে। তাঁর শিক্ষণ-পদ্ধতি এখন ঝাড়খণ্ডের বাইরেও বিস্তৃত হয়েছে। কর্ণাটক, অরুণাচল প্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্যের স্কুলগুলো ইতিমধ্যেই এই মডেল গ্রহণ করেছে। জামশেদপুরের ডিবিএমএস স্কুল এবং অরুণাচল প্রদেশের সৈনিক স্কুলসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান Schoologium পদ্ধতি ব্যবহার করছে। এমনকি নীতি আয়োগ এবং ঝাড়খণ্ড সরকারও এটিকে আরও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে।
একটি পরীক্ষাগারে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সাজিদ হুসেন
ড. সাজিদ বলেন, “এখনও পর্যন্ত মাত্র ২০% শিক্ষার্থী চাকরি পাচ্ছে, এবং এর মধ্যে মাত্র ৫-১০% ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে। বিশেষত ঝাড়খণ্ডের ৭৬ শতাংশ গ্রামীণ শিশুর জীবন পরিবর্তন করা দরকার; তারা সমান সুযোগের যোগ্য।”
২০১৭ সালে তিনি শিশুদের জন্য এক নতুন ধরনের পাঠ্যপুস্তক তৈরি করে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন। সাত বছরের পরিশ্রমের পর ২০২৪ সালে Schoologium Books প্রকাশিত হয়, ৪৮টি উদ্ভাবনীমূলক কিন্ডারগার্টেন বই, যা মেকার-বেসড ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষণপদ্ধতির উপর নির্ভর করে তৈরি।
এই প্রকল্পে আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়, ডিপিএস রাঁচি এবং ঝাড়খণ্ড টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক এ. এ. খান বলেন, “এই বইগুলো প্রাথমিক শিক্ষায় সৃজনশীলতা ও গভীরতা এনেছে। এগুলো শিশুদের আনন্দ ও কৌতূহলের সঙ্গে শেখার সুযোগ দেয়।” ২০২৫-২৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে জামশেদপুরের ডিবিএমএস কদমা স্কুলসহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই বইগুলো ব্যবহার শুরু করবে। ইতিমধ্যেই ৮৫টি গ্রামের ২৬,০০০-রও বেশি শিশু স্কুলজিয়াম মডেল থেকে উপকৃত হয়েছে।
সাজিদ হুসেনের শিশুদের টেলিস্কোপের ব্যবহার দেখানোর একটি দৃশ্য
এর ফলাফল স্পষ্ট, যারা একসময় স্কুলে যেতে অনাগ্রহী ছিল, তারা এখন আনন্দের সঙ্গে স্কুলে যাচ্ছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে ও সৃজনশীল শিক্ষার প্রতি উৎসাহিত হচ্ছে। অভিভাবকরাও তাদের সন্তানের মধ্যে পরিবর্তন অনুভব করছেন। আগে শিশুরা না বুঝে মুখস্থ করত, এখন তারা প্রশ্ন করে, সমালোচনামূলকভাবে ভাবে এবং অনুসন্ধান করে জ্ঞান অর্জন করছে।
ড. সাজিদের যাত্রা প্রমাণ করে, প্রকৃত শিক্ষা প্রতিটি শিশুর মধ্যে কৌতূহল, সৃজনশীলতা ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলে। তাঁর পরবর্তী স্বপ্ন, এমন একটি স্কুল গড়া, যেখানে বড় বড় বই বা কংক্রিটের দেয়াল থাকবে না; বরং শিশুরা মাঠ, বাগান, বাজার ও দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সরাসরি শিখবে। তিনি বলেন, “আমরা শুধু চাকরিপ্রার্থী তৈরি করতে চাই না; আমরা নিয়োগদাতা তৈরি করতে চাই।”
আজ ঝাড়খণ্ডের রাঁচির নিকটবর্তী চিতরপুর গ্রামের এই ছোট্ট স্থানটি শিক্ষাগত উদ্ভাবনের এক কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি হাজারো গ্রামীণ শিশুর ভবিষ্যৎ বদলে দিয়েছে। ড. সাজিদ হুসেন প্রমাণ করেছেন, দৃঢ় বিশ্বাস, দূরদৃষ্টি ও আবেগ থাকলে সাধারণ পরিবারের সন্তানও শিক্ষার জগতে এক বিপ্লব ঘটাতে পারে।