“জন্মদিনে বিশেষ স্মরণ: একজন বিজ্ঞানী, শিক্ষক ও প্রেরণাদাতা— ড. এ. পি. জে. আবদুল কালাম”

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 12 d ago
ড. এ. পি. জে. আবদুল কালাম ( ফাইল)
ড. এ. পি. জে. আবদুল কালাম ( ফাইল)
 
অপর্ণা দাস / গুয়াহাটি

প্রতিটি প্রজন্মেই এমন কিছু মানুষ জন্মান, যাঁরা কেবল তাঁদের যুগকেই নয়, পরবর্তী প্রজন্মগুলোকেও অনুপ্রেরণা দেন। ড. এ. পি. জে আবদুল কালাম তেমনই এক মানুষ , নামটার মধ্যেই যেন একটা অদ্ভুত আলো মিশে আছে। তাঁর জীবনটাই যেন এক জীবন্ত বার্তা। মিসাইল ম্যান, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, বিজ্ঞানী- এসব তকমা তাঁর পরিচয়ের এক ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। আসলে তিনি ছিলেন এক বিনম্র সাধক, এক অন্তহীন প্রেরণার উৎস।
 
১৯৩১ সালের আজকের দিনে তামিলনাড়ুর রমেশ্বরমে জন্ম নেন কালাম। বাবা ছিলেন নৌকাচালক, মা গৃহিণী। ছোটবেলায় অর্থাভাব ছিল চরম, তবুও তাঁর চোখে ছিল জেদ- শেখার, জানার আর উড়ে যাওয়ার। পত্রিকা বিলি করে তিনি নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতেন।
 
ড. এ. পি. জে. আবদুল কালাম
 
ছোটবেলায় যখন তাঁর জীবনের গল্প পড়েছিলাম, তখনই মনে হয়েছিল, কতটা ইচ্ছাশক্তি, কতটা নিষ্ঠা থাকলে একজন দরিদ্র জেলে পরিবারের ছেলে দেশের রাষ্ট্রপতি হতে পারে! রমেশ্বরমের সেই মাটির ঘরে জন্ম নিয়ে যিনি নিজের অধ্যবসায় আর বিশ্বাসে উড়ে গেলেন মহাকাশে- সত্যিই অবিশ্বাস্য!
 
আমি যখনই ড. এ. পি. জে আবদুল কালামের কথা ভাবি, মনে হয় তিনি যেন এখনো আমাদের মাঝেই আছেন, একটা বইয়ের পাতায়, একটা বাক্যের মধ্যে, কিংবা কোনো তরুণের চোখের স্বপ্নে। তাঁর জীবনের মতোই তাঁর লেখা বইগুলোও আমাদের শেখায়, জীবনের প্রতিটি সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সম্ভাবনা আছে। 
 
আজকের প্রজন্মের অনেকেই মোবাইল আর সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যে হারিয়ে যায়। কিন্তু কালাম স্যার শিখিয়েছেন, স্ক্রিনের আলোয় নয়, নিজের মনের আলোয় উজ্জ্বল হতে। তাঁর বইগুলোর প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন আমাদের ভেতরের আগুনটাকে একটু একটু করে জ্বেলে দেয়।
 
ড. এ. পি. জে আবদুল কালামের লেখা বিভিন্ন বইয়ের ছবি

স্বপ্ন শুধু দেখা নয়, তাকে বাস্তব করার সাহস থাকা দরকার। কালাম স্যার নিজের জীবন দিয়ে সেই শিক্ষা দিয়েছেন। রমেশ্বরমের ছোট্ট ঘর থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত তাঁর যাত্রা আমাদের বলে যায়, অসীম সম্ভাবনার শুরু হয় এক বিন্দু বিশ্বাস থেকে। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ "উইংস অফ ফায়ার" ( wings of fire)- এ তিনি লিখেছেন:
 
“স্বপ্ন সেই নয় যা ঘুমিয়ে দেখা যায়, স্বপ্ন সেই যা ঘুমোতে দেয় না।”
 
তিনি রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরও নিজেকে ‘শিক্ষক’ বলেই পরিচয় দিতেন। তিনি বলতেন, “আমি একজন শিক্ষক, এবং সেটাই আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।” রাষ্ট্রপতি ভবনের জৌলুস তাঁর চোখে ছিল না- ছিল ছাত্রদের মুখে, তাদের প্রশ্নে, তাদের স্বপ্নে। আমি মনে করি, এমন মানুষ খুব কমই জন্মান, যিনি ক্ষমতার আসনে থেকেও এতটা সাধারণ, এতটা মানবিক হতে পারেন।
 
ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে এপিজে আব্দুল কালামের একটি ছবি 
 
তাঁর লেখা বই যেন জীবনের পাঠশালা। তাঁর প্রতিটি লেখা যেন বলছে, নিজেকে বিশ্বাস করো, ব্যর্থতাকেও আলিঙ্গন করো, কারণ তাতেই শেখা আছে। কলাম স্যার বিশ্বাস করতেন যে তরুণরাই দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাঁর "ইগনাইটেড মাইন্ডস" (Ignited Minds) বইতে তিনি লিখেছেন: 
 
“তরুণের জ্বালানো মস্তিষ্কই পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পদ।”
 
আসলে তিনি সবসময়ই কল্পনা করেছিলেন, একটা আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক কিন্তু মূল্যবোধে ভরপুর ভারতের। এবং তরুণদের  শিক্ষাদানের মাধ্যমেই এই স্বপ্ন পূরণ সম্ভব তা তিনি বিশ্বাস করতেন।
 
ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কথোপকথনের একটি মুহূর্তে ড. এ. পি. জে আবদুল কালাম
 
তিনি শিখিয়েছিলেন, আমরা প্রত্যেকেই কিছু না কিছু পরিবর্তন আনতে পারি, যদি আমরা নিজেদের ভেতরের আগুনটা জ্বালিয়ে রাখতে পারি। তাঁর জীবন ছিল প্রমাণ- দরিদ্রতা, ব্যর্থতা, সীমাবদ্ধতা কিছুই আটকাতে পারে না এক সত্যিকারের স্বপ্নবাজকে। কালাম স্যার বলতেন:
 
 “তুমি যদি সূর্যের মতো জ্বলতে চাও, আগে সূর্যের মতো পুড়তে শিখো।”
 
আজকের প্রজন্ম প্রযুক্তির যুগে বাস করছে, যেখানে মনোযোগের ঘাটতি আর হতাশা সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু কালাম স্যারের বইগুলো তরুণদের অন্তর্মুখী করে তোলে, আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। তাঁর লেখা পড়ে তারা বুঝতে শেখে; সফলতা মানে শুধু চাকরি নয়, বরং নিজেকে তৈরি করা। তাঁর রচিত "ইন্ডিয়া ২০২০" (India 2020), " মাই জার্নি" (My journey), " ইউ আর বর্ন টু ব্লসম" (You are born to blossom), "দ্যা লাইফ ট্রী"(The Life Tree) এই বইগুলো শুধু জীবনী নয়- ওগুলো হলো প্রেরণার অস্ত্র, আত্মবিশ্বাসের প্রতীক, আর দেশগঠনের দিশা।
 
গ্রন্থাগারে ড. এ. পি. জে আবদুল কালামের একটি ছবি
 
প্রেরণাদায়ক এই ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি ভবনের রাজকীয় পরিবেশেও ছিলেন অবিকৃত। খাবারে পছন্দ ছিল ইডলি-সাম্বর, পোশাকে সাধারণ সাদা শার্ট-প্যান্ট। তাঁর টেবিলে থাকত তিনটি বই- গীতা, কুরআন ও বাইবেল। আর দিন শুরু হতো ছাত্রদের চিঠি পড়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্ম নয়, মানুষই আসল। মৃত্যুর দিনেও (২৭ জুলাই, ২০১৫) তিনি ছিলেন আইআইএম শিলঙে ছাত্রদের মাঝে, বক্তৃতা দিতে গিয়ে; যেন মৃত্যুও তাঁকে শেখানো থেকে বিরত করতে পারেনি। 
 
 “Let your wings of fire take you to the sky of success.”

অর্থাৎ তোমার আগুনের ডানাকে ছড়িয়ে দাও ও সফলতার আকাশে উড়ে যাও- এই লাইন আজও কোটি তরুণের হৃদয়ে জ্বলছে। 
 
আজ তাঁর জন্মদিনে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হচ্ছে। ভারতের বিভিন্ন স্থানে তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্টিত হচ্ছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। তবে  আজ তাঁর জন্মদিনে, আমরা সবাই যেন একবার নিজের মনকে প্রশ্ন করি, আমরা কি সেই আগুনটাকে এখনও জ্বালিয়ে রাখতে পেরেছি? যদি না পারি, তবে আজই শুরু হোক নতুন করে  এই যাত্রা।
 
সর্বশেষে ইতি টানতে পারি এই বলে যে- তিনি চলে গেছেন, কিন্তু তাঁর ডানা আজও ভারতের আকাশে উড়ে বেড়ায় ,আর আমাদের মনেও রেখে গেছেন একটাই বার্তা , স্বপ্ন দেখো আর সেই স্বপ্নে আলো দাও।