দেবকিশোর চক্রবর্তী:
ভারতের ৫১ পীঠের অন্যতম কালীঘাট মন্দির আজও ভক্তসমাজের আস্থার কেন্দ্র। জনশ্রুতি, কিংবদন্তি ও ঐতিহাসিক তথ্যের অনন্য মিশেলে এই পীঠস্থান গড়ে তুলেছে এক রহস্যময় ঐতিহ্য, যা কালক্রমে ধর্মচেতনার সঙ্গে মিশে গেছে।
১৭৯৮ সালের বর্ষাকালে বড়িশার জমিদার সাবর্ণ গোত্রজ সন্তোষ রায়চৌধুরি একদিন আদিগঙ্গায় নৌকাবিহারে বেরিয়ে কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ শুনে এক অজানা জঙ্গলে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি এক বৃদ্ধ সাধকের কাছ থেকে জানতে পারেন—এই স্থানেই সতীর দক্ষিণ শ্রীচরণের আঙুল পতিত হয়েছে। সাধকের বর্ণনায় অনুপ্রাণিত হয়ে সন্তোষবাবু দক্ষিণাকালীর পাকা মন্দির নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। যদিও তিনি কাজ শেষ করে যেতে পারেননি, তাঁর পুত্র রামনাথ ও ভ্রাতুষ্পুত্র রাজীবলোচন রায় ১৮০৯ সালে মন্দির সম্পূর্ণ করেন। সেই সময় মন্দির নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৩০ হাজার টাকা, যার মধ্যে ২৫ হাজার টাকার দান আসে কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী চূড়ামণি দত্তের পরিবার থেকে।
চূড়ামণি দত্তের এই দান নিয়েও প্রচলিত রয়েছে এক কাহিনি। তাঁর পুত্র কালীপ্রসাদ দত্ত এক মুসলমান রমণীর প্রেমে পড়ে সমাজচ্যুত হন। পিতার মৃত্যুর পর ধর্মীয় আচার পালনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হলে রামদুলাল সরকারের মধ্যস্থতায় সন্তোষ রায়চৌধুরি তাঁকে সাহায্য করেন। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ কালীপ্রসাদ ২৫ হাজার টাকা দান করেন, যা কালীঘাট মন্দির নির্মাণে ব্যয়িত হয়।
ইতিহাস বলে, কালীঘাটে সাধক আত্মারাম ব্রহ্মচারী ও ব্রহ্মানন্দ গিরি প্রথম জঙ্গল পরিষ্কার করে দক্ষিণাকালী ও নকুলেশ্বর শিবের পূজার্চনা শুরু করেন। অলৌকিকভাবে কালীকুন্ড হ্রদ থেকে সতীর প্রস্তরীভূত অঙ্গুলি উদ্ধার করা হয় জৈষ্ঠ্য মাসের এক পূর্ণিমা রাতে। আজও সেই অঙ্গুলি রূপোর বাক্সে মায়ের বেদীর নিচে সংরক্ষিত।
কালীঘাট প্রসিদ্ধ কালীমন্দির এবং একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম হিন্দু তীর্থক্ষেত্র
নবাব আলিবর্দী খান থেকে আকবরের সেনাপতি মানসিংহ পর্যন্ত অনেক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের নাম এই মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত, যদিও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ অপ্রতুল। ১৭৭০ সালে হুজরিমল্ল নামে এক সেনানায়ক আদিগঙ্গার ঘাট বাঁধিয়ে দেন ও কয়েকটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন। পরে গোরক্ষপুরের টিকা রায় ও আন্দুলের জমিদার কাশীনাথ রায় মন্দিরের ভোগঘর, নহবতখানা ও নাটমন্দির নির্মাণে অবদান রাখেন। এখানেই ১৮৯৯ সালে ভগিনী নিবেদিতা বক্তৃতা দেন মা কালীর মহিমা নিয়ে।
কালীঘাটের মায়ের প্রতিমা অনন্য। শ্বেতপাথরের বেদিতে শায়িত মহাদেবের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন রক্তবর্ণা দেবী। নাসিকায় বিষ্ণুতিলক — যা ভারতের অন্য কোনও কালীমূর্তিতে নেই। প্রতিদিন মায়ের সঙ্গে বাসুদেবেরও পূজা হয়; মায়ের ভোগ আমিষ, আর বাসুদেবের নিরামিষ। বেলা তিনটেয় মা অন্ন গ্রহণ করেন — ভাত, ডাল, মাছ, মাংস, পোলাও, চাটনি, পায়েসে ভরা রাজভোগের আয়োজন থাকে প্রতিদিন।
স্বয়ং রামকৃষ্ণ পরমহংস, মা সারদা, স্বামী বিবেকানন্দের মাতা, শ্রী লোকনাথবাবা, বামাক্ষ্যাপা, শ্যামাচরণ লাহিড়ী, আনন্দময়ী মা সকলে কালীঘাটের মায়ের দর্শন করেছেন। আজও অসংখ্য ভক্ত তাঁদের মানত ও প্রার্থনা নিয়ে আসেন এই চিরজাগ্রত পীঠে।
কালীপুজোর রাতে এখানে দেবীকে আরাধনা করা হয় লক্ষ্মীরূপে — “শ্যামা লক্ষ্মী পূজা” নামে পরিচিত এই উৎসবে মন্দির চত্বর মুখর থাকে হাজারো প্রদীপে। কালীঘাট শুধু একটি মন্দির নয়, এটি বাংলার ধর্ম, ইতিহাস ও জনমানসের চিরন্তন বিশ্বাসের প্রতীক।