ত্রিবেণীর জাফর খান গাজি মসজিদ: বাংলার প্রথম মসজিদে মিলনের অমল শিখা

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 19 h ago
জাফর খান গাজি মসজিদ
জাফর খান গাজি মসজিদ
 
শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ

ধর্মের নামে বিভেদ আজ যেন নিত্যসঙ্গী। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে রাজপথ, কোথাও বাদ নেই তর্ক, সংঘাত, অভিযোগ। কিন্তু এই বাংলাতেই ইতিহাস এক অনন্য গল্প বলে, বিভেদের মধ্যেও মিলনের। সেই গল্পের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে বাংলার প্রাচীনতম মসজিদ, জাফর খান গাজি মসজিদ, হুগলির ত্রিবেণীতে।
 
ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিকের ঘটনা। তখনো মুঘল যুগ আসেনি। ত্রিবেণীর হিন্দু রাজত্বে এক মুসলমান প্রজার বাড়িতে কুরবানির আয়োজনকে কেন্দ্র করে রাজার অসন্তোষ ও শাস্তি প্রদানের ঘটনা সব ইতিহাসের মূল। ক্ষুব্ধ প্রজা সরাসরি নালিশ জানান দিল্লির বাদশাহের কাছে। রাজা বনাম বাদশাহের সংঘাতের সূত্র ধরে ত্রিবেণীর মাটিতে অবতীর্ণ হন সেনানায়ক জাফর খান গাজি। সেই যুদ্ধে পরাজিত হন হিন্দুরাজা, বিজয়ী জাফর খান বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেন।
 
'জাফর খান গাজী মসজিদ' এর ভেতরের দৃশ্য
 
শাসকেরা সব যুগেই নিজের বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছেন। কেউ বানিয়েছেন মূর্তি, কেউ স্তম্ভ, কেউ আবার ধর্মস্থল। জাফর খানও তার ব্যতিক্রম নন। তাই বিজয়ের স্মারক হিসেবেই ১২৯৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি নির্মাণ করেন এই মসজিদ। আজও এর গায়ে টেরাকোটার সূক্ষ্ম কারুকাজ, আরবি ও সংস্কৃত শিলালিপি, এমনকি দশাবতার, মঙ্গলঘট, কল্পলতা ও প্রদীপের নকশা যেন মিলে মিশে তৈরি করেছে এক আশ্চর্য শিল্পভাষা।
 
এই মসজিদের পাশেই রয়েছে দরগা, যেখানে আজও জাফর খান গাজি, তাঁর পুত্র, নাতি ও হুগলির তৎকালীন হিন্দু রাজকন্যা  যিনি জাফর খান গাজির বেগম ছিলেন তাঁর সমাধি। দুই ধর্ম, দুই সংস্কৃতি, একই সঙ্গে চিরনিদ্রায় শায়িত এই দরগায় যেন চিরন্তন ঐক্যের প্রতীক। আরও বিস্ময়কর, দরগার ভিতরে আজও সংরক্ষিত রয়েছে বিষ্ণুমূর্তি, বুদ্ধমূর্তি ও জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মূর্তি। অর্থাৎ, এক মসজিদের অঙ্গনেই মিলেছে ভারতের চার প্রধান ধর্মের প্রতীক! হয়তো ধ্বংসের ইতিহাসের মধ্য দিয়েই এখানে জন্ম নিয়েছিল সহাবস্থানের এক নীরব দর্শন। 
 
'জাফর খান গাজী মসজিদ' প্রাঙ্গণের একটি ছবি
 
‘কেমব্রিজ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’-র তৃতীয় খণ্ডেও উল্লেখ রয়েছে, “It is not at Gaur, but at Tribeni in the Hughli District, that the oldest remains of Muslim buildings have survived... built largely out of the materials taken from a temple of Krishna.” অর্থাৎ, এখানে এক ধর্মস্থলের ধ্বংসের ইট দিয়েই গড়ে উঠেছিল আরেক ধর্মস্থল, কিন্তু তার গায়ে খোদাই হয়ে রইল মিলনের ভাষা, যেখানে মসজিদের দেওয়ালে শোভা পায় হিন্দু দেবদেবীর প্রতিমা, সংস্কৃত শ্লোক আর টেরাকোটার ঐতিহ্য।
 
জাফর খান ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান, অথচ তিনিই ছিলেন গঙ্গার পূজারি। গঙ্গার তীরে তাঁর নির্মিত এই মসজিদ যেন নদীর মতোই বহমান, স্রোতে আছে ভক্তি, আছে সহনশীলতা, আছে সম্প্রীতির স্বচ্ছতা। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তাঁর লেখায় বন্দনা করেছেন এই মুসলমান সেনানায়ককে:
 
‘পাজোয়ায় বন্দিয়া যাবো শুভি খাঁ পীরে,
জফর খাঁ গাজীরে বন্দো ত্রিবেণীর ধারে।’
 
আজও ত্রিবেণীর গঙ্গা যেন ঢেউ তুলে প্রণাম জানায় সেই শাসককে, যিনি যুদ্ধের মধ্য দিয়েও রেখে গেছেন মিলনের উত্তরাধিকার। স্থানীয় মুসলমানেরা আজও নামাজ পড়েন এখানে, হিন্দুরা মাথা ঠেকান দরগার মাটিতে।
 
'জাফর খান গাজী মসজিদ' এর গায়ে খোদাই করা হিন্দু দেবদেবীর প্রতিমা
 
১৮৭২ সালে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগের (Archaeological Survey of India) জোসেফ ডেভিড বেগলার জাফর খান গাজির মসজিদ ও সমাধির অভ্যন্তরের ছবি তোলেন। তখন মসজিদটি গাছপালা ও লতাগুল্মে আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছিল এবং ভগ্নাবস্থার কারণে ধ্বংসের মুখে ছিল। বেগলার তাঁর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, স্থাপনাটির নির্মাণে সম্ভবত হিন্দু মন্দিরের কিছু উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে, বিশেষত দরজার চৌকাঠ ও লিন্টেলে খোদাই করা পাথর।  তিনি ধারণা করেন, যে মন্দিরগুলির উপর জাফর খানের এই সমাধি গড়ে উঠেছে, সেগুলির স্থাপত্যশৈলী ১১শ শতকের  রাজাদের  নির্মিত মন্দিরগুলির সঙ্গে মিল রয়েছে। ঐ মন্দিরগুলি হিন্দু দেবদেবীর জটিল ভাস্কর্য ও মহাকাব্যিক কাহিনির দৃশ্যচিত্রের জন্য পরিচিত ছিল।
 
১৯০৯ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সাতগাঁও ও ত্রিবেণীর প্রত্নাবশেষ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেন, যা জাফর খান গাজির মসজিদ কমপ্লেক্সের উৎপত্তি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে। তাঁর পরিদর্শনের সময় মন্দিরগুলো প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, তবে মূল স্থাপনার ওপর যে কালো ব্যাসল্ট পাথরের চৌকি ছিল, তা  মূল মন্দিরের ভিত্তির অংশ হিসেবে শনাক্ত করা  হয়েছিল। বন্দ্যোপাধ্যায় আরও উল্লেখ করেন যে স্তম্ভগুলিতে খোদাই করা দেবদেবীর অবশিষ্টাংশ ও হিন্দু মহাকাব্যের দৃশ্যাবলির নিদর্শন পাওয়া গেছে।
 
মসজিদ প্রাঙ্গণের একটি ছবি
 
মসজিদের ভেতরে তিনি  চারটি মূর্তির ছাপ শনাক্ত করেন, যার মধ্যে একটি স্পষ্টভাবে গদাধার বিষ্ণুর প্রতিকৃতি ছিল। তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মূল স্থাপনাটি আসলে একটি বিষ্ণু মন্দির ছিল, যেখানে আরও প্রাচীন বৌদ্ধ ও জৈন স্থাপনার টুকরোও যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে চারজন বুদ্ধের ভূমিস্পর্শ মুদ্রার (bhūmisparśa pose) চিত্র এবং জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মূর্তির অংশ, বিশেষ করে পদদ্বয় ও বিশাল শেশনাগের কুণ্ডলিত দেহ, অন্তর্ভুক্ত ছিল।
 
এর থেকেই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে জাফর খান গাজি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষে মসজিদ নির্মাণ করলেও সম্পূর্ণভাবে মন্দিরের অস্তিত্বকে বিলুপ করে দেননি। উপরন্তু তিনি মসজিদের অংশ হিসেবেই হিন্দু , বুদ্ধ, জৈন দেবতাদের প্রতিকৃতিকে স্থান দিয়েছেন এবং এটিকে একটি ধর্মীয় ঐক্যের উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। বাংলার প্রথম মসজিদ তাই শুধু স্থাপত্য নয়, এ এক মানবতার দলিল, ঐক্যের প্রতীক, সম্প্রীতির শাশ্বত মন্ত্র। ৭২৪ বছরের পুরনো এই মসজিদ আজও যেন বলে ওঠে, ধর্ম আলাদা হতে পারে, কিন্তু মাটি, নদী, মানুষ; সব এক।