শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ ঃ
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম — যিনি একাধারে প্রতিবাদের, আবার ভক্তির প্রতীক। সমাজে অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে তিনি যেমন কলম ধরেছিলেন, তেমনি দেবী শক্তির প্রতি তাঁর অনুরাগ তাঁকে শ্যামা সঙ্গীতের এক অনন্য স্রষ্টায় পরিণত করেছিল। তাঁর সাহিত্য ও সঙ্গীতে বিদ্রোহের পাশাপাশি মিশে ছিল দেবী কালী বা শ্যামার প্রতি নিবিড় ভক্তি ও আত্মনিবেদন।
বিংশ শতকের উত্তাল ভারতবর্ষে নজরুলের কণ্ঠেই প্রথম শোনা গিয়েছিল শোষিত মানুষের মুক্তির গান। ‘বিদ্রোহী’, ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ বা ‘ধূমকেতু’র মতো কবিতা শুধু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকেই অনুপ্রাণিত করেনি, একে পরিণত করেছিল সাংস্কৃতিক বিপ্লবে। অথচ এই প্রতিবাদী কবিই ছিলেন কালীসাধক — যাঁর শ্যামা সঙ্গীতে ভক্তি ও বিদ্রোহ একাকার হয়ে গেছে।
তৎকালীন সমাজে নজরুলের এই ভক্তি চর্চা ছিল অত্যন্ত বিতর্কিত। মুসলিম হয়েও হিন্দু দেবীর বন্দনা করার কারণে এক শ্রেণির ধর্মান্ধ মানুষ তাঁকে ‘কাফির’ আখ্যা দেয়। নজরুল নিজেই লিখেছিলেন ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় —
“দেব–দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে।”
তবু তাঁর বিশ্বাস ছিল, ভক্তির কোনো ধর্ম নেই। শক্তিই সর্বোচ্চ, আর সেই শক্তি মূর্ত হয় মা শ্যামায়।
শ্যামা সঙ্গীতের ঐতিহ্য বহু পুরনো — রামপ্রসাদ সেনের হাতে যার প্রাণ সঞ্চার, সেই ধারাকে নজরুল নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেন। তাঁর রচিত প্রায় ৪০০০ গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশই শ্যামা সঙ্গীত। ‘রাঙা-জবা’ গ্রন্থে সংকলিত ১০০টি গান নজরুলের ভক্ত হৃদয়ের উন্মোচন। তাঁর কলমে মা শ্যামা কেবল পৌরাণিক দেবী নন, তিনি ছিলেন শক্তির প্রতীক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা প্রতিবাদের প্রতিরূপ।
নজরুল লিখেছিলেন—
“ভক্তি, আমার ধুপের মত, ঊর্ধ্বে উঠে অবিরত,
শিবলোকের দেব দেউলে, মা’র শ্রীচরণ পরশিতে।”
এই গানে যেমন ভক্তির গভীরতা, তেমনি তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতায় ধরা পড়েছে দেবী শক্তির জাগরণে সমাজ পরিবর্তনের আহ্বান —
“ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?”
শ্যামা সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে নজরুল নারীশক্তিকে রূপ দিয়েছিলেন দেবীমূর্তিতে। তাঁর কাছে মা কালী ছিলেন প্রতিবাদের সাহস, শক্তি ও মুক্তির প্রতীক। তাই তাঁর গানে যেমন ভক্তির আর্তি, তেমনি রয়েছে জাগরণের আহ্বান।
ধর্মীয় দৃষ্টিতে নজরুলের শ্যামা সঙ্গীত যত বিতর্কিতই হোক, তার শিল্প ও ভাবগভীরতা বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে অনন্য। আজও পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে শ্যামা সঙ্গীতের আসর শুরু হয় নজরুলের সৃষ্টিতেই। তাঁর কণ্ঠের মাধ্যমে ভক্তি ও বিদ্রোহ একাকার হয়ে উঠেছিল — যেখানে কালীভক্তি আর মানবমুক্তির স্বপ্ন একই সুরে বাজে।