কবি জীবনানন্দ দাশ: নিঃশব্দ নীহারিকার কবি দুদণ্ড শান্তির খোঁজে

Story by  atv | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 5 d ago
কবি জীবনানন্দ দাশ: নিঃশব্দ নীহারিকার কবি দুদণ্ড শান্তির খোঁজে
কবি জীবনানন্দ দাশ: নিঃশব্দ নীহারিকার কবি দুদণ্ড শান্তির খোঁজে
 
শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ 

বাংলা সাহিত্যের আকাশে জীবনানন্দ দাশ এক অনন্য নক্ষত্র। তিনি নিসর্গ, নিঃসঙ্গতা ও স্বপ্নের কবি— আধুনিক বাংলা কবিতার ভাষায় যিনি এক নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন। ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ সালে কলকাতায় ট্রামের ধাক্কায় তাঁর আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে আমরা স্মরণ করি সেই কবিকে, যিনি নিস্তব্ধতা ও প্রকৃতির সৌন্দর্য দিয়ে বাংলা কবিতাকে এক স্বতন্ত্র মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিলেন।

১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন জীবনানন্দ দাশ। তাঁর পিতা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন শিক্ষক ও সমাজসংস্কারক, আর মাতা কুসুমকুমারী দাশ নিজেও ছিলেন একজন কবি। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্যচর্চার আবহে বড় হয়ে ওঠা জীবনানন্দ অচিরেই নিজের কবিতার জগৎ নির্মাণ করেন, যা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা— গভীর, ধীর, স্বপ্নিল এবং একা।

তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরাপালক (১৯২৭) বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে। এরপর প্রকাশিত রূপসী বাংলা, মহাপৃথিবী, বনলতা সেন, বেলা অবেলা কালবেলা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ তাঁকে প্রতিষ্ঠা দেয় আধুনিক কবিতার অগ্রদূত হিসেবে।

বিশেষ করে বনলতা সেন কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী সৃষ্টি। তিনটি স্তবকজুড়ে কবি যেন যুগযুগান্তের ক্লান্ত মানবযাত্রার প্রতীককে তুলে ধরেছেন— যেখানে বনলতা সেন কেবল এক নারী নন, বরং ক্লান্ত আত্মার আশ্রয়, নিঃসঙ্গ জীবনের পরম শান্তি।
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিঁধু নদীর ধূসর জলরাশি থেকে নিশীথের অন্ধকারে...”
এই বিখ্যাত পঙ্‌ক্তিতে কবি মানবজীবনের এক চিরন্তন ক্লান্তি ও অন্বেষার কথা বলেছেন, আর সেই অন্বেষার শেষে তিনি খুঁজে পান বনলতা সেনের মুখে শান্তি— “সকল দিনের শেষে শিশিরের শব্দে পাখির নীড়ে ফিরে আসার মতো।”

জীবনানন্দের কবিতায় প্রকৃতি কখনও নিছক দৃশ্য নয়, বরং জীবনের সহযাত্রী। ধানক্ষেত, নদী, পাখি, কুয়াশা— এ সবই তাঁর কবিতায় আত্মার প্রতীক হয়ে ওঠে। রূপসী বাংলা-তে তিনি যেন মাটির গন্ধে, নদীর স্রোতে, গ্রামের নির্জনতায় নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পান। “আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে”— এই পঙ্‌ক্তি তাঁর অমর প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি।

তাঁর জীবন ছিল নিঃসঙ্গ, কিন্তু সেই নিঃসঙ্গতাই তাঁর কবিতার উৎস। শিক্ষকতা ও সাহিত্যচর্চা করেও জীবদ্দশায় তিনি প্রাপ্য স্বীকৃতি পাননি। মৃত্যুর পরেই তিনি হয়ে ওঠেন বাংলা আধুনিক কবিতার এক মহাগুরু।

১৯৫৪ সালের অক্টোবরে তাঁর মৃত্যুর ঘটনাটি ছিল যেমন বেদনাদায়ক, তেমনি যেন তাঁর কবিতারই প্রতিচ্ছবি— নীরবে, আলো-আঁধারিতে মিশে যাওয়া এক কবির পরিণতি।

আজ তাঁর প্রয়াণ দিবসে আমরা স্মরণ করি সেই কবিকে, যিনি লিখেছিলেন 
 
“মানুষ হারায়— তবু পৃথিবী হারায় না।”
 
জীবনানন্দ দাশও হারাননি; তাঁর কবিতা, তাঁর বনলতা, তাঁর রূপসী বাংলা আজও আমাদের জীবনের গোপন সুর হয়ে বেঁচে আছে— চিরন্তন, নিঃশব্দ, অথচ গভীরভাবে জাগ্রত।