গোবর্ধন পুজো ২০২৫: প্রকৃতি ও শ্রীকৃষ্ণের প্রতি কৃতজ্ঞতার উৎসব

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 4 d ago
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি
 
অনিতা

ভারতবর্ষ উৎসবের দেশ। এখানে প্রতিটি পুজো কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং ভক্তি, ঐতিহ্য, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির গভীর অনুভবের প্রতিফলন। দীপাবলির পর পালিত গোবর্ধন পুজো বা অন্নকূট উৎসব সেই বিশেষ পবিত্র দিনের একটি, যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেই ঐশ্বরিক লীলার স্মরণে পালিত হয়, যখন তিনি ইন্দ্রদেবের অহংকার ভঙ্গ করে গোবর্ধন পর্বতের পুজো করেছিলেন।
 
এই দিনে সারা দেশের মন্দিরে, বিশেষ করে মথুরা, বৃন্দাবন, নন্দগাঁও ও গোকুলে, জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন হয়। ভক্তরা গোময় দিয়ে গোবর্ধন পর্বতের প্রতীক তৈরি করে পুজো করেন এবং অন্নকূটের প্রসাদ রান্না করে ভগবানকে নিবেদন করেন।
 
অন্ন দিয়ে তৈরি গোবর্ধন পর্বতের প্রতীক
 
পঞ্জিকা অনুসারে পুজোর তিথি
 
বৈদিক পঞ্জিকা অনুযায়ী, এই বছর কার্তিক শুক্ল পক্ষের প্রতিপদা তিথি শুরু হবে ২১ অক্টোবর ২০২৫ সন্ধ্যা ৫টা ৫৪ মিনিটে, এবং শেষ হবে ২২ অক্টোবর ২০২৫ সন্ধ্যা ৮টা ১৬ মিনিটে। উদয়তিথি অনুসারে গোবর্ধন পুজো পালিত হবে বুধবার, ২২ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে।
 
পুজোর শুভ মুহূর্ত
 
এই বছর প্রাতঃকালের পুজোর শুভ সময় সকাল ৬টা ২৬ মিনিট থেকে ৮টা ৪২ মিনিট পর্যন্ত। অপরাহ্ন বা সায়ংকালের পুজোর শুভ মুহূর্ত দুপুর ৩টা ১৩ মিনিট থেকে সন্ধ্যা ৫টা ৪৯ মিনিট পর্যন্ত। এই তিথিতে স্বাতি নক্ষত্র ও প্রীতি যোগ থাকবে। বিশেষ তাৎপর্য হলো, এই দিনে সূর্য তুলা রাশিতে ও চন্দ্রও সেখানে অবস্থান করবেন, ফলে পুজোর সময় শুভ ও কল্যাণকর বলে ধরা হচ্ছে।
 
গোবর্ধন পুজোর বিধি
 
গোবর্ধন পুজোর পদ্ধতি সহজ হলেও এতে ভক্তি, নিষ্ঠা ও পবিত্রতা অপরিহার্য। সকালে স্নান সেরে ঘর বা আঙিনা পরিষ্কার করুন। গোময় দিয়ে গোবর্ধন পর্বতের প্রতীক তৈরি করুন, যাকে গিরিরাজ বলা হয়। ফুল, দীপ, রঙোলি দিয়ে সেটিকে সাজান। গোবর্ধন পর্বতের চারপাশে দীপ জ্বালান। তুলসীপাতা, জল, চাল, ফুল, ধূপ, দীপ, নৈবেদ্য ও মিষ্টান্ন সাজিয়ে রাখুন।
 
অন্নকূটের জন্য খীর, পুরি, তরকারি, ভাত, মিষ্টান্নসহ নানা পদ রান্না করুন। প্রথমে গোমাতা বা গরুর পুজো করুন, কারণ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে গরু ও গৌসেবার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এরপর গোবর্ধন পর্বতের পুজো করুন, জল, ফুল, চাল, দুধ, দই, ঘি ও নৈবেদ্য নিবেদন করুন। পুজো শেষে গোবর্ধন পর্বতের সাতবার প্রদক্ষিণ করুন।
 
শ্রী কৃষ্ণের গোবর্ধন পর্বত তুলে ধরার দৃশ্যকে জহির করে নির্মিত মূর্তি
 
গোবর্ধন পুজোর গুরুত্ব
 
গোবর্ধন পুজোর মূল বার্তা হলো “প্রকৃতির পূজা ও সংরক্ষণ”। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই মানুষকে শিখিয়েছিলেন যে দেবতার চেয়ে প্রকৃতি ও কর্মই জীবনের আসল শক্তি। গোবর্ধন পর্বতের পুজো মানে প্রকৃতি, ভূমি, পর্বত, জল, বায়ু ও প্রাণীজগতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। গোময় দিয়ে গোবর্ধন পর্বত তৈরি করা ও গরুর সেবা করার তাৎপর্য হলো পরিবেশ ও পশুজগতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন।
 
গোবর্ধন পুজোর পৌরাণিক কাহিনি
 
শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণে উল্লেখ রয়েছে যে একসময় বৃন্দাবনের মানুষ ইন্দ্রদেবের পুজো করতেন, যাতে বৃষ্টি হয় ও ফসল ভালো হয়। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “ইন্দ্র নয়, গোবর্ধন পর্বতের পুজো করো। এই পর্বতই আমাদের ফল, ফুল, ঘাস ও জল দেয়, যা দিয়ে আমাদের গরুগুলো বেঁচে থাকে।”
 
গ্রামবাসীরা কৃষ্ণের কথা মেনে ইন্দ্রপুজো ত্যাগ করে গোবর্ধন পর্বতের পুজো শুরু করলেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্র প্রবল বৃষ্টি নামালেন। সারা ব্রজ জলে ভেসে গেল। তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর কনিষ্ঠ আঙুলে গোবর্ধন পর্বত তুলে ধরলেন এবং সকল মানুষ, গরু ও প্রাণীকে আশ্রয় দিলেন। সাত দিন ধরে অবিরাম বৃষ্টি চলল, কিন্তু কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হল না। শেষে ইন্দ্র নিজের ভুল বুঝে কৃষ্ণের কাছে ক্ষমা চাইলেন। কৃষ্ণ বললেন, “অহংকার কখনও মঙ্গলজনক নয়। আমাদের সর্বদা প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত।” এই ঘটনাকে স্মরণ করেই প্রতিবছর গোবর্ধন পুজো দিবস পালিত হয়।
 
গোবর্ধন পর্বতের ধর্মীয় ও ভৌগোলিক গুরুত্ব
 
গোবর্ধন পর্বত উত্তরপ্রদেশের মথুরা জেলায় অবস্থিত। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮ কিলোমিটার, উচ্চতা প্রায় ২৫ মিটার। এটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অলৌকিক শক্তির জীবন্ত প্রতীক। প্রতি বছর লক্ষাধিক ভক্ত এখানে গোবর্ধন পরিক্রমা করেন, যা প্রায় ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর উল্লেখযোগ্য স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে দানঘাটি, রাধাকুণ্ড, গোবিন্দকুণ্ড, পুঁছরী কা লোটা ও মানসী গঙ্গা।
 
অন্নকূট মহোৎসব
 
গোবর্ধন পুজোর দিনই পালিত হয় অন্নকূট উৎসব। এই দিনে শ্রীকৃষ্ণের মন্দিরগুলোতে বিভিন্ন রকমের রান্না করা খাদ্য সাজিয়ে ভগবানকে নিবেদন করা হয়। মথুরা ও বৃন্দাবনের মন্দিরে ৫৬ ভোগ (ছপ্পন ভোগ) নিবেদন করার বিশাল আয়োজন হয়। ভক্তদের বিশ্বাস, যে ব্যক্তি এই দিনে ক্ষুধার্তকে আহার করায় বা গোমাতাকে খাওয়ায়, সে জীবনে কখনও অন্নের অভাবে পড়ে না। পরে ভক্তরা প্রসাদ গ্রহণ করেন ও অন্নকূটের বিতরণ করেন।
 
অন্নকূট উৎসবের একটি দৃশ্য
 
আধ্যাত্মিক বার্তা
 
গোবর্ধন পুজো আমাদের শেখায় যে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা মানবজীবনের ধর্ম। “শ্রীমদ্ভাগবত গীতা”-য় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “প্রকৃতি মম রূপিণী”  অর্থাৎ, সমগ্র প্রকৃতি আমারই রূপ।
স্বামী বিবেকানন্দও বলেছেন, “প্রকৃতির পূজাই ঈশ্বরের সত্য আরাধনা, কারণ ঈশ্বর সেই প্রকৃতিতেই বিরাজমান।”
 
এই পুজোতে আরও গভীর বার্তা নিহিত রয়েছে, শ্রীকৃষ্ণ ইন্দ্রের অহংকার ভঙ্গ করে দেখিয়েছিলেন যে ক্ষমতা বা পদ নিয়ে গর্ব করা অনুচিত। গরুর সেবা ছাড়া গোবর্ধন পুজো অসম্পূর্ণ; এটি পশুসম্পদের গুরুত্বের প্রতীক। কৃষ্ণ ব্রজবাসীদের একত্র করে যে সামূহিক পুজোর প্রথা চালু করেছিলেন, তা সামাজিক ঐক্যের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
 
বিদেশে গোবর্ধন পুজো
 
ভারতের মথুরা, বৃন্দাবন, হরিদ্বার, বারাণসি, দিল্লি, বিহার, গুজরাট, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানে বিশেষ পুজো ও অন্নকূট উৎসবের আয়োজন হয়। নেপালে একে “অন্নকূট উৎসব” নামে ডাকা হয়।
ফিজি, মরিশাস ও ট্রিনিডাডসহ বহু দেশে বসবাসকারী ভারতীয়রাও ভক্তিভরে এই পুজো পালন করেন।
 
গোবর্ধন পুজো শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আচার নয়, বরং প্রকৃতি, জীবজগৎ ও সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উৎসব। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এই বাণী আজও সমান প্রাসঙ্গিক, “যে প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা করে, সেও আসলে ঈশ্বরের সত্য ভক্ত।”