অপর্ণা দাস / গুয়াহাটি
একটি সুর, একটি আহ্বান, দুটি শব্দ “বন্দে মাতরম”। এই দুটি শব্দে যেন লুকিয়ে আছে ভারতবর্ষের জাগরণের সমগ্র ইতিহাস। আজ থেকে দেড় শতাব্দী আগে, ১৮৭৫ সালে, যখন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর আনন্দমঠ উপন্যাসে এই গানটির জন্ম দেন, তখন তিনি হয়তো জানতেন না, এই সুর একদিন পরাধীন জাতির স্বাধীনতার মন্ত্র হয়ে উঠবে, এবং শতাব্দী পেরিয়েও তার প্রতিধ্বনি ভারতের প্রতিটি হৃদয়ে অনুরণিত হবে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে ভারত ছিল পরাধীনতার ঘন আঁধারে ঢাকা। ইংরেজ শাসনের কষাঘাতে দেশের মানুষ আত্মসম্মান হারিয়ে ফেলেছিল, সমাজে ভয় ও আত্মবিস্মৃতির ছায়া। বঙ্কিমচন্দ্র তখন ব্রিটিশ প্রশাসনের একজন আধিকারিক হলেও, তাঁর হৃদয়ে জ্বলছিল স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। ইংরেজ শাসনের প্রভাবে দেশবাসীর আত্মসম্মান হারিয়ে যাচ্ছিল, জাতীয় চেতনা ছিল ম্রিয়মাণ। এমন এক সময়ে তিনি বুঝেছিলেন; রাজনীতির চেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হলো সাহিত্য ও সংস্কৃতি। তাঁর উপন্যাস আনন্দমঠ-এর মধ্যেই তিনি জাতির প্রতি এক অদম্য ভক্তি ও মাতৃভূমির পুজোর মন্ত্র রচনা করেন। সেখানেই প্রথমবার ধ্বনিত হয়:
“বন্দে মাতরম, সুজলাং সুফলাং মলয়জশীতলাং...”
বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে “মা” মানে কেবল নারী দেবতা নয়, বরং সেই ভূমি; যার বুকে তিনি জন্মেছেন, যে তাঁকে অন্ন, বায়ু ও আশ্রয় দিয়েছে। এইভাবেই ১৮৭৫ সালে জন্ম নিল ভারতের আত্মার গান, “বন্দে মাতরম”।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত 'আনন্দমঠ' উপন্যাসের প্রচ্ছদ ও উপন্যাসে উল্লেখিত 'বন্দে মাতরম' গান
শুরুতে এটি ছিল সাহিত্যের অংশ; কিন্তু ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় তা পরিণত হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীকী মন্ত্রে। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, নারী সকলের মুখে এক সুর, এক আহ্বান, “বন্দে মাতরম!” যেখানে ছিল প্রতিবাদের সাহস, আত্মত্যাগের শপথ, এবং দেশমাতার প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। ব্রিটিশ সরকার বারবার এই গান নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে, কারণ তারা বুঝেছিল, যে গান মানুষকে এক করে দিতে পারে, সেটিই তাদের শাসনের সবচেয়ে বড় শত্রু। তবুও এই গান গেয়েছেন কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বিপ্লবীরা; কারাগারের অন্ধকার কুঠুরিতেও “বন্দে মাতরম”-এর সুরে জেগে উঠেছিল আশা। রাস্তায়, বিদ্যালয়ে, সভা-মিছিলে, এই গানই ছিল ঐক্যের চাবিকাঠি।
১৯০৬ সালে কলকাতায় প্রথম যে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল, সেটি ছিল সবুজ, হলুদ ও লাল তিন রঙের কাপড়ে তৈরি, আর তার মাঝখানে বড় অক্ষরে লেখা ছিল “বন্দে মাতরম”। এই পতাকাটি আজকের জাতীয় পতাকার পূর্বসূরী। প্রতিটি রঙের ছিল গভীর প্রতীকী অর্থ; লাল মানে শক্তি, হলুদ মানে জ্ঞান, আর সবুজ মানে সমৃদ্ধি। মাঝখানের “বন্দে মাতরম” ছিল সেই আত্মার আহ্বান, যা স্বাধীনতার আন্দোলনকে একত্র করেছিল। পরে, মহাত্মা গান্ধী ও অন্যান্য নেতারা পতাকার রূপ পরিবর্তন করলেও, “বন্দে মাতরম”-এর চেতনা থেকেই জন্ম নেয় ভারতের ত্রিবর্ণ পতাকার ভাবনা, যা আজও দেশপ্রেম ও ঐক্যের প্রতীক।
১৯০৬ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় জাতীয় পতাকার যাত্রার প্রতীকী ছবি
স্বাধীনতা লাভের পরেও “বন্দে মাতরম”-এর যাত্রা থেমে যায়নি। ১৯৫০ সালে এটি ভারতের জাতীয় গান হিসেবে স্বীকৃতি পায়, আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষচন্দ্র বসু, এবং মহাত্মা গান্ধীর মতো ব্যক্তিত্বরা এর মাহাত্ম্যকে বারবার তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “এই গানেই ভারতের আত্মার সুর।” সুভাষচন্দ্র বসু স্বাধীনতা সংগ্রামী বাহিনীর পতাকা উত্তোলনের সময়ও উচ্চারণ করতেন এই মন্ত্র, “বন্দে মাতরম”। ১৫০ বছর পেরিয়েও এই গানের গুরুত্ব কমেনি, বরং সময়ের সঙ্গে তা আরও গভীর হয়েছে। এটি কেবল ইতিহাস নয়, এটি ভারতের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও আত্মমর্যাদার প্রতীক।
২০২৫-এর প্রজন্ম হয়তো যুদ্ধ করছে না কোনো শাসকের বিরুদ্ধে, কিন্তু তারা লড়ছে নতুন ধরণের সংগ্রাম, বেকারত্ব, দূষণ, বৈষম্য, প্রযুক্তির নেশা এবং মানবিকতার অভাবের বিরুদ্ধে। এই প্রজন্মের কাছে “বন্দে মাতরম” মানে হলো, নিজের দেশকে ভালোবাসা শুধু আবেগ নয়, এটি কর্মের মাধ্যমে প্রকাশ। যে তরুণ স্টার্টআপ তৈরি করছে, যে ছাত্রী বিজ্ঞান বা শিল্পকলায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে, যে যুবক গ্রামে ফিরে সমাজ গড়ছে, তাদের সকলের অন্তরে লুকিয়ে আছে সেই একই চেতনা, যে চেতনা একদিন বঙ্কিমচন্দ্র জাগিয়ে দিয়েছিলেন। আজ সমগ্র ভারতজুড়ে উদ্যাপিত হচ্ছে “বন্দে মাতরম”-এর ১৫০ বছর পূর্তি, জাতীয় গর্ব ও ঐক্যের এই অমর সুরে আবারও মুখরিত হয়েছে দেশ।
একটি গান, যা সাহিত্য থেকে আন্দোলন, আন্দোলন থেকে প্রেরণায় রূপান্তরিত হয়েছে, সেটিই আজও ভারতের আত্মার প্রতীক। ১৫০ বছর পরেও, “বন্দে মাতরম” আমাদের শেখায়; দেশপ্রেম মানে কেবল শ্লোগান নয়, এটি এক অন্তরের সাধনা; জাতীয়তা মানে কেবল সীমান্ত নয়, এটি এক মানসিক ঐক্য; আর মাতৃভূমি মানে শুধু ভূমি নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি। বঙ্কিমচন্দ্রের সেই আহ্বান আজও প্রাসঙ্গিক- যতদিন ভারত থাকবে, যতদিন তরুণ হৃদয়ে আশা থাকবে, ততদিন এই সুর বাজবে প্রতিটি প্রভাতে, প্রতিটি মিছিলে, প্রতিটি হৃদয়ে:
“বন্দে মাতরম, বন্দে মাতরম।”