নেহরুর দ্বিধা, প্যাটেলের দৃঢ়তা: কাশ্মীর সংযুক্তির অন্তর্লীন কাহিনি

Story by  Aasha Khosa | Posted by  Aparna Das • 13 h ago
মহারাজা হরিসিংহ ও সর্দার প্যাটেলের মধ্যে হওয়া ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারের একটি ছবি (ফাইল)
মহারাজা হরিসিংহ ও সর্দার প্যাটেলের মধ্যে হওয়া ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারের একটি ছবি (ফাইল)
 
আশা খোসা / নয়াদিল্লি

সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, যিনি ভারতের “আয়রন ম্যান” নামে পরিচিত, আধুনিক ভারতের স্থপতি হিসেবে ৫৫৬টি দেশীয় রাজ্য, রাজ্যসভা ও জমিদারি অঞ্চল, এমনকি হায়দ্রাবাদ, জুনাগড় এবং পরবর্তীতে গোয়া’র মতো বিরোধী রাজ্যগুলিকেও একত্রিত করে ভারতের মানচিত্র গঠনে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনিই সময়মতো সেনাবাহিনীকে শ্রীনগরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন, যার ফলে কাশ্মীর পাকিস্তানের হাতে পড়া থেকে রক্ষা পায়।
 
“জওহরলাল, তুমি কি কাশ্মীর চাও, না সেটা দিয়ে দিতে চাও?”, এই উদ্ধৃতিটি এসেছে ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশ’র একটি রেকর্ড করা ভিডিও সাক্ষাৎকার থেকে। তখন তিনি দিল্লির মিলিটারি ডিরেক্টরেটে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পরিকল্পনা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। মানেকশো ১৯৪৭ সালের এক উত্তপ্ত বিতর্কের কথা বর্ণনা করেন, যেখানে সর্দার প্যাটেল প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে কাশ্মীর বিষয়ে তাঁর দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করেন, পাকিস্তানি বাহিনী ২২ অক্টোবর ১৯৪৭-এ কাশ্মীর আক্রমণ করার পরপরই।
 
জহরলাল নেহেরু ও প্যাটেলের মধ্যে হওয়া একটি সাক্ষাৎকারের ছবি (ফাইল)
 
“নেহরু তখনকার মতোই জাতিসংঘ, রাশিয়া, আফ্রিকা, ঈশ্বর সবাই নিয়ে বক্তৃতা করছিলেন, যতক্ষণ না সর্দার প্যাটেল ধৈর্য হারান। তিনি বলেন, ‘জওহরলাল, তুমি কি কাশ্মীর চাও, না দিতে চাও?’ নেহরু বলেন, ‘অবশ্যই আমি কাশ্মীর চাই।’ তখন প্যাটেল বলেন, ‘তাহলে আদেশ দাও।’ এবং নেহরু কিছু বলার আগেই প্যাটেল আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘তুমি তোমার আদেশ পেয়ে গেছ।’”,  ভিডিও সাক্ষাৎকারে এমনটাই বলেন স্যাম মানেকশো।
 
ব্লুক্রাফট ডিজিটাল ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত নতুন বই “৩৭০: আনডুইং দ্য আনজাস্ট – এ নিউ ফিউচার ফর জে অ্যান্ড কে”–এর তথ্য অনুযায়ী, নেহরু জানতেন যে পাকিস্তান সেনা ও উপজাতি বাহিনী নিয়ে কাশ্মীর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তবুও তিনি মহারাজা হরিসিংহ (ভারতের রাজনীতিক ড. করণ সিংহের পিতা)-এর দিল্লিতে পাঠানো এসওএস সত্ত্বেও কাশ্মীরের ভারতীয় অন্তর্ভুক্তি এবং সেনা পাঠানোর বিষয়ে বিলম্ব করেন।সেই বৈঠকে, যখন নেহরু অবশেষে স্বীকার করেন যে তিনি কাশ্মীর রাখতে চান, তখনই প্যাটেল সেনা মোতায়েনের নির্দেশ দেন, নেহরু পরবর্তী আদেশ জারি করার আগেই।
 
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, যদি প্যাটেল তখন হস্তক্ষেপ না করতেন, তাহলে হামলাকারীরা শ্রীনগর বিমানবন্দর দখল করে ফেলত, যার ফলে ভারতীয় সেনারা সেখানে অবতরণই করতে পারত না এবং খাইবার পাখতুনখোয়া থেকে আসা উপজাতি ও নিয়মিত সৈন্যদের প্রতিহত করা অসম্ভব হয়ে যেত। ভারতীয় সেনার শিখ ব্যাটালিয়ন ২৭ অক্টোবর শ্রীনগরে অবতরণ করে, একদিন আগে, অর্থাৎ মহারাজা হরিসিংহ ভারতের সঙ্গে সংযুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করার পরদিন, এবং কাশ্মীরকে রক্ষা করে। এর আগে নেহরু মহারাজা হরিসিংহের ভারতের সঙ্গে যোগদানের প্রস্তাব একাধিক শর্ত জুড়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
 
মহাত্মা গান্ধী, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ও জহরলাল নেহেরু মধ্যে হওয়া একটি সাক্ষাৎকারের ছবি (ফাইল)
 
কাশ্মীরই ছিল একমাত্র অঞ্চল, যেখানে প্রধানমন্ত্রী নেহরুর ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে প্যাটেল হস্তক্ষেপ করেননি। নেহরুর পূর্বপুরুষের ভূমির প্রতি অতিরিক্ত অনুরাগ ও শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কারণে তিনি কাশ্মীর প্রশ্নে যুক্তিসঙ্গত নন, এমনটাই মনে করতেন প্যাটেল। তবুও, প্যাটেল নেহরুর কার্যকলাপের ওপর নজর রাখছিলেন, কিন্তু সরাসরি হস্তক্ষেপ করেননি, যতক্ষণ না পাকিস্তানি বাহিনী কাশ্মীর দখলের মুখে ফেলে।
 
শেষমেশ, যখন পরিস্থিতি হাতের বাইরে যেতে বসেছিল, তখনই প্যাটেল কঠোরভাবে পদক্ষেপ নেন। ২৬ অক্টোবর রাতেই এক দল দিল্লি থেকে কাশ্মীরে উড়ে যায় এবং মহারাজা হরিসিংহকে সংযুক্তির দলিলে স্বাক্ষর করানো হয়। পরদিন সকালে শিখ সৈন্যদের প্রথম বিমান শ্রীনগরে নামে, এবং খুব দ্রুতই হামলাকারীদের পরাজিত করে শ্রীনগরের উত্তরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পুনর্দখল করা হয়।
 
এরপর প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সামনে আসে ভারতীয় জনগণকে কাশ্মীর সংযুক্তির ঘোষণা দেওয়ার মুহূর্ত। তিনি সবার সঙ্গে প্যাটেলসহ বক্তব্যের খসড়া নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু, লর্ড মাউন্টব্যাটেনের প্রভাবে, নেহরু শেষ মুহূর্তে সেই খসড়া পরিবর্তন করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে জম্মু ও কাশ্মীরের সংযুক্তি হবে শর্তসাপেক্ষ, জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে জনমতের (plebiscite) ওপর নির্ভরশীল।
 
১৯৪৭ সালে ভারতীয় সেনার শিখ ব্যাটেলিয়ান কাশ্মীরে অবতরণ করার একটি ছবি (ফাইল)
 
৩৭০: আনডুইং দ্য আনজাস্ট বইটিতে বলা হয়েছে, “২৮ অক্টোবর সন্ধ্যায় নেহরুর ভাষণ নির্ধারিত হওয়ার কয়েক মিনিট আগে সর্দার প্যাটেল এই অস্বস্তিকর প্রতিশ্রুতি টের পান এবং হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেন। ‘তবে তাঁর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, কারণ নেহরু ইতিমধ্যেই ব্রডকাস্টিং হাউসে পৌঁছে গিয়েছিলেন। শেষ চেষ্টায় প্যাটেল তাঁর সহকারী শঙ্করকে সেখানে পাঠান, যাতে নেহরুকে জাতিসংঘ-সম্পর্কিত বাক্যাংশটি বাদ দিতে বলা যায়। কিন্তু শঙ্কর পৌঁছানোর আগেই ভাষণ শুরু হয়ে গিয়েছিল, এবং প্রতিশ্রুতিটি জনসমক্ষে ঘোষণা করা হয়ে গিয়েছিল।’”
 
এই ঘোষণায় প্যাটেল হতবাক হয়ে যান, কারণ গণভোটের (plebiscite) কোনো প্রয়োজনই ছিল না, জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাকিস্তানকে প্রথমে পোখ (POK) এলাকা থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে হতো।নেহরুর এই ভুলের ফলে কাশ্মীর নিয়ে ভারতের অবস্থান সাত দশক ধরে অস্পষ্ট থেকে যায়। এতে স্থানীয় জনগণের মনে সংযুক্তি নিয়ে দ্বিধা সৃষ্টি হয়, আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং পাকিস্তানের হাতে বহুবারের হাইব্রিড যুদ্ধ ও সন্ত্রাসবাদ চালানোর অজুহাত জোগায়।