গুরু নানক ও শংকরদেব: আধ্যাত্মিক ঐক্যের দুই আলোকস্তম্ভ

Story by  Pulin Deka | Posted by  Aparna Das • 1 d ago
মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শঙ্করদেব ও গুরু নানক
মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শঙ্করদেব ও গুরু নানক
 
  পুলিন ডেকা 

অপরূপ দেশ ভারত ভূমি আধ্যাত্মিকতার পীঠস্থান। পাঁচ হাজার বছরের সভ্যতা ও সংস্কৃতির ধারক এই দেশের আধ্যাত্মিক শক্তি আজও মানুষকে জাগ্রত করে রেখেছে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ভারতে যে আধ্যাত্মিক জাগরণের সূচনা হয়েছিল, তা ছিল ভারতের ইতিহাসে এক গভীর তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায়। যাঁরা এই জাগরণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে গুরু নানক ছিলেন অন্যতম।

মধ্যযুগে অসমে মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শঙ্করদেব সনাতন সত্তাকে জাগিয়ে তোলার জন্য যে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন, তা সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক জগতে এক নতুন চিন্তার উদ্ভব ঘটিয়েছিল। মহাপুরুষের অবদানে অসমিয়া জাতির স্বকীয়তার এক উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটে। কিন্তু গুরু নানক ও শঙ্করদেবের দর্শন, চিন্তা, ও মানবিক দায়িত্ববোধ, এই সব ক্ষেত্রেই এক আশ্চর্য ঐক্যের স্রোত দেখা যায়। শৈশবকাল থেকেই দুই মহাপুরুষ স্বভাবতই জ্ঞান ও ধর্মবোধে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন। তাঁদের সৃষ্টিশীল প্রতিভা শিশু বয়সেই চারিদিকে বিস্ময় জাগিয়েছিল।
 
গুরুদ্বারা শ্রী তেগ বাহাদুর সাহেব, ধুবড়ি
 
শিশুকালে শঙ্করদেব ফলার শিক্ষা নেওয়ার সময় ‘করতল কমল’ নামে এক কবিতা রচনা করেছিলেন। ঠিক তেমনই গুরু নানকও বর্ণমালা ও অক্ষর নিয়ে কবিতা লিখে সকলকে অভিভূত করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই দুই মহাপুরুষ ধর্মের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। কিশোর বয়সে শঙ্করদেব টোলে শিক্ষা লাভ করে মহান ভারতীয় ধর্মগ্রন্থগুলির জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। গুরু নানকও শৈশবকাল থেকেই উপলব্ধি করেছিলেন যে মানবকল্যাণই ধর্মের মূল তত্ত্ব। সেই উপলব্ধি থেকেই তিনি গৃহত্যাগ করে সত্যের সন্ধানে যাত্রা শুরু করেন।
 
সত্যের অনুসন্ধানে তিনি দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করেন। তবে শেষে নিজের জন্মভূমিতেই তিনি ঈশ্বরীয় জ্ঞানের সত্য উপলব্ধি করেন। দিব্য জ্ঞানলাভের পর তিনি শিখ ধর্মের মাধ্যমে মানবতার যে পথ দেখিয়ে যান, তা আজ সমগ্র বিশ্বের জন্য এক অমূল্য সম্পদ।
 
গুরু নানকের মতে, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর ভক্তি ও নামস্মরণের মাধ্যমেই মানুষ ঈশ্বরপ্রাপ্ত হয়। মানবপ্রেম ও মানবসেবা শিখ ধর্মের মূল মন্ত্র। অপরদিকে, মহাপুরুষ শঙ্করদেব এক শরণ হরিনাম ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে দেখিয়ে গেছেন যে শ্রীকৃষ্ণই পরম শক্তি এবং তাঁরই ভক্তি মানুষের মুক্তির পথ। গুরু নানক বলেছিলেন, ঈশ্বরের নামস্মরণে মৃত্যুভয় নাশ হয়; মৃত্যু তখন আমাদের স্পর্শ করতে পারে না।
 
শঙ্করদেবও বলেছিলেন, পাপী যদি হরিনামের শরণ নেয়, তবে মুক্তিলাভ সম্ভব। গুরু নানক বলেছেন, ঈশ্বরের নামকীর্তনে যে পূর্ণতা পাওয়া যায়, তা তপ, দান বা তীর্থের মাধ্যমে অর্জন করা যায় না। শঙ্করদেব দেখিয়ে গেছেন, হরিনামের স্মরণেই মানুষ ভগবানের হৃদয়ে স্থান লাভ করে। দুই মহাপুরুষই ধর্মকে মানবপ্রেমের উৎকৃষ্ট রূপে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
 
কেন্দ্রীয় গুরুদ্বারার সম্মুখে বরকোলার অসমিয়া শিখেদের একটি দল
 
তাঁরা সমাজের প্রতিটি জাতি ও জনগোষ্ঠীকে একতার সুত্রে বাঁধতে চেয়েছিলেন। গুরু নানক সর্বধর্মের সমন্বয়ের আহ্বান জানিয়েছিলেন। শিখ ধর্ম প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি বিশ্বজনীন এক গুরুতে পরিণত হন। তাঁর চিন্তা, দর্শন ও মানবতাবাদ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে প্রসারিত হয়। শিখ ধর্ম জীবনের পবিত্রতা ও নৈতিকতার ওপর গুরুত্ব দেয়। একইভাবে শঙ্করদেবও জীবনযাপন, কর্ম, সাহস, শৃঙ্খলা ও দৃঢ়তার শিক্ষা দিয়েছেন।
 
প্রকৃতি, সমাজ, ও ব্যক্তির ভক্তি; এই তিনের মিলিত সত্তাই ধর্ম। জীবনের নিরাপত্তা, সুখ-দুঃখ, ও সামাজিক শৃঙ্খলা রক্ষায় মানুষ ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জীবনধারার পথ বেছে নেয়। মানুষ তার জীবন ও মৃত্যুর পরিণতি নিয়ে চূড়ান্ত চিন্তার মধ্য দিয়ে ধর্মীয় চেতনায় প্রবেশ করে।
 
ধর্মের উৎস স্থিরভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, কিন্তু সমাজজীবনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। যখন সমাজে বিশৃঙ্খলা, নৈতিক অবক্ষয়, হিংসা-স্বার্থপরতা বাড়ে, তখনই আবির্ভাব ঘটে এক মহাপুরুষের, যিনি সমাজে নতুন গতি আনেন। এমনই এক মহাপুরুষ ছিলেন গুরু নানক। তাঁর দর্শন ও বাণী মানবজাতিকে দিয়েছে নতুন প্রেরণা, নতুন শক্তি।
 
শিখ ধর্মের জীবনতত্ত্ব মানুষকে নৈতিকভাবে পরিচালিত করে। গুরু নানক জীবনের শিক্ষা, সামাজিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার মাধ্যমে জ্ঞানের আলোকপ্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছেন। তাই একবিংশ শতাব্দীতে তাঁর ভাবনা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
 
অসমের ধনপুরে অবস্থিত গুরুদ্বারা বরসা সাহেব
 
গুরু নানক ছিলেন এক নৈতিক শিক্ষক ও সমাজসংস্কারক। তিনি কখনও আধ্যাত্মিকতার সেই বিমূর্ত ও অনুপযোগী দিককে সমর্থন করেননি। বরং মানুষ ও জীবনের বাস্তব সমস্যার মধ্যেই সত্যের সন্ধান করেছেন। তাঁর জ্ঞানতত্ত্ব মানবপ্রেমে পূর্ণ ছিল।
 
মানুষকে ভালোবাসতে শেখানোই ছিল তাঁর প্রকৃত সাধনা। আজকের হিংসা-দ্বেষে পরিপূর্ণ পৃথিবীতে মানবতাবাদ পুনরুদ্ধার করতে হলে গুরু নানকের আদর্শেই চলতে হবে। শান্তি ও ভালোবাসার স্রোত বয়ে আনতে হলে তাঁর দর্শনই হতে পারে পথপ্রদর্শক।
 
(লেখক একজন সাহিত্যিক। গুরু নানকের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হলো।)