লখনউয়ের খাদ্য সংস্কৃতি বহন করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা

Story by  atv | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 1 d ago
প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি
প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি
 
বিদুষী গৌর / নয়াদিল্লি

পুরনো লখনউয়ের রাস্তাগুলিতে ধীরে ধীরে সেদ্ধ হওয়া বিরিয়ানির গন্ধ, মুখে গলে যাওয়া কাবাব আর মিষ্টির সুবাস যেন বারবার ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যা শুধুই খাদ্য নয় — বরং এটি শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা এক সংস্কৃতি, যেখানে রাজপরিবার ও সাধারণ মানুষের রান্নাঘর, পথঘাট এবং গল্পগুলো একসঙ্গে মিলেমিশে আছে।

সম্প্রতি শহরটির রন্ধনশৈলীর ঐতিহ্য এক শক্তিশালী নতুন স্বীকৃতি পেয়েছে। কারণ, খাদ্য ঐতিহ্যের বিশ্বমানচিত্রে এর গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে ইউনেস্কো লখনউকে গ্যাস্ট্রোনমির সৃজনশীল শহর (Creative City of Gastronomy) হিসেবে ঘোষণা করেছে।

লখনউয়ের খাদ্যের মূল উৎস নবাবদের রাজকীয় রান্নাঘর। সেখানে ‘দম-পুখত’ (সিল করা পাত্রে ধীরে ধীরে রান্না করার কৌশল) প্রণালী ব্যবহার করে সাধারণ উপাদানগুলোকে বহুস্তরীয় রাজকীয় স্বাদে উন্নীত করা হতো। বিখ্যাত গলৌটি ও টুন্ডে কাবাব থেকে শুরু করে চোখি মাটন নিহারি, সুগন্ধি আওধি বিরিয়ানি, এবং সূক্ষ্ম নিরামিষ পদ ও মিষ্টান্ন—সবকিছুই রসনাবিলাসীদের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়।
 

চায়ের সঙ্গে বন-মাখন ও সিঙরা
 
তবুও এই খাদ্যসংস্কৃতি রাজকীয় ভোজের সীমা ছাড়িয়ে আরও অনেক গভীর সামাজিক তাৎপর্য বহন করে। কারণ এটি এমন এক সমাজবিন্যাসের ফল, যেখানে মুসলমান নবাব, হিন্দু কারিগর ও ব্যবসায়ী, পথের বিক্রেতা ও গৃহস্থালির রান্নাঘর — সকলে মিলে এক যৌথ খাদ্য ঐতিহ্যকে গড়ে তুলেছে। এই সামষ্টিক ঐতিহ্যই লখনউয়ের ইউনেস্কো স্বীকৃতির মূল ভিত্তি, যেখানে রান্নার পদ্ধতি, পদ ও আতিথেয়তার ধরন কীভাবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মিলেমিশে গেছে, সেটিকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

লখনউয়ে খাদ্য শুধুমাত্র জীবিকার উৎস নয়, বরং এটি সংস্কৃতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে এক সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছে। শহরের বিখ্যাত “গঙ্গা-জমুনি তহজীব” হল সেই মিলিত সংস্কৃতির পরিচয় — যেখানে হিন্দু ও মুসলমানরা পাশাপাশি বসবাস করে, উৎসব ও খাদ্যের ভাগাভাগি করে, এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধার মাধ্যমে একে অপরের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে।

একটি উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বড়া মঙ্গল উৎসবের সময় একটি নবাবী পরিবার সমস্ত ধর্মের মানুষকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সমবেত ভোজের আয়োজন করে — যা ছিল অন্তর্ভুক্তি ও সম্প্রীতির প্রতীক।
 
বাস্কেট চাট

স্টেশনের একটি প্ল্যাটফর্মে দেখা যায়, মুসলমান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের বিক্রেতারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পুরি-সবজি, কচুরি, জিলাপি ট্রে ও কাবাব বিক্রি করছেন। কোনো বিবাহের মেনুতে নিরামিষ আওধি থালি এবং ধীরে সেদ্ধ মাংসের কোরমা—দুটিই থাকতে পারে। রাস্তার ধারে কড়াইয়ের গোল ঘূর্ণিতে চাটনি ও সুগন্ধির মিশ্রণ শুধুমাত্র কোনো এক ধর্মের নয়; এটি শহরের সমষ্টিগত পরিচয়ের প্রতীক।

ইউনেস্কোর এই সম্মান কেবল প্রতীকী ছিল না। আবেদন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে লখনউ পর্যটন দপ্তর ঐতিহ্যবাহী রান্নাঘর, রাস্তার খাবারের দোকান, পুরনো রেসিপি, মৌখিক ঐতিহ্য ও বিক্রেতাদের ইতিহাস একত্র করে একটি খাদ্য মানচিত্র (Culinary Map) প্রস্তুত করে। এই পদবীর সঙ্গে এখন সরকারি ও স্থানীয় নীতিনির্ধারকেরা ছোট খাদ্য উদ্যোক্তাদের টেকসই রান্নার পদ্ধতির প্রসার ও গ্যাস্ট্রোনমিক পর্যটন বৃদ্ধিতে সহায়তা করার লক্ষ্যে কাজ করছে।

খাদ্যরসিকদের জন্য শহরটি এক অনন্য যৌথ আবেদন উপস্থাপন করে। নিরামিষ ও রাজপথের জলপান থেকে শুরু করে নিহারি ও বিরিয়ানি পর্যন্ত—সবকিছুই সমান শ্রদ্ধার সঙ্গে উপভোগ করা হয়। “বাজপেয়ী কি পুরি”, “দুর্গা কে খাস্তা”, “মোটিচূর কে লাড্ডু”, বা মালাই পানের মতো মিষ্টান্ন—এই সব নিরামিষ ক্লাসিক খাবারই প্রমাণ করে যে, আওধি রন্ধনশৈলী শুধুমাত্র এক সম্প্রদায়ের নয়; এটি লখনউয়ের মিলিত আত্মার প্রতিচ্ছবি।
 
গলৌটি কাবাব
 
 লখনউয়ের এই খাদ্যকাহিনী এক গভীর সামাজিক বার্তা বহন করে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, এই শহরে সম্প্রদায় ও রান্নার কাজ সবসময় পাশাপাশি চলে এসেছে। খাবার ভাগ করে নেওয়া লখনউয়ের দীর্ঘদিনের জীবনধারার অংশ — এবং এমন সময়ে, যখন সমাজ বিভাজনের মুখোমুখি, তখন লখনউয়ের রাস্তাগুলো উল্টো একতার ছবি তুলে ধরে। এই শহরে নানা ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে বসে আহার করে, একে অপরকে সেবা দেয় এবং ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখে।

কোনো পর্যটক হয়তো আমিনাবাদে গিয়ে দেখবেন, শিখ পরিবার ও মুসলমান কাবাব প্রস্তুতকারীরা পাশাপাশি কাজ করছেন। তিনি শুনতে পারেন, এক জৈন সম্প্রদায়ের বিক্রেতা ভোরবেলায় পুরি-সবজির নাস্তার ডাক দিচ্ছেন। কিংবা তিনি অংশ নিতে পারেন কোনো সাম্প্রদায়িক ভোজে, যেখানে ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে সমানভাবে আপ্যায়ন করা হয়।

এই ছোট ছোট ঘটনাগুলো প্রমাণ করে যে, এই শহরে “নিজের” বলে পরিচয় দেওয়া কেবল নাম বা ধর্ম দিয়ে নয়, বরং অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। যখন খাবার ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক কিংবা আর্থিক সীমানা অতিক্রম করে, তখন তা এক সার্বজনীন ভাষা হয়ে ওঠে। প্রতিটি প্লেট — তা ঝুড়ি চাট হোক বা নবাবি বিরিয়ানি — একত্রে ভাগ করে নেওয়া হয়, যা সম্প্রীতি ও মিলনের বার্তা বহন করে।

বাজপেয়ী কি পুরি

একজন পর্যটকের জন্য লখনউতে গলৌটি কাবাবের অর্ডার দেওয়া মানে শুধু মাংস-মসলার স্বাদ নেওয়া নয় — এটি শতাব্দীব্যাপী শিল্প, সহানুভূতি ও ভাগাভাগি করে বেঁচে থাকার ঐতিহ্য-এর স্বাদ নেওয়া। রাস্তার বিক্রেতার ঝুড়ি চাট থেকে শুরু করে রাজপ্রাসাদের বিরিয়ানি — প্রতিটি পদই সম্প্রদায়ের সীমানা পেরিয়ে এক জীবন্ত উত্তরাধিকার রচনা করে।

লখনউ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, খাবার কেবল স্বাদের কথা বলে না — এটি ইতিহাস, পরিচয় ও ঐক্যের কথাও বলে।ইউনেস্কো লখনউকে যখন “গ্যাস্ট্রোনমির সৃষ্টিশীল শহর” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তখন সেটি শুধু রান্নার কৌশলের সম্মান নয় — এটি শহরের সহাবস্থান ও মানবিকতার সংস্কৃতির স্বীকৃতি।

এই নবাবি শহরে, যেখানে পেস্ট্রির পাশে পুরি, আর প্লাজায় কাবাবের ধোঁয়া মেশে সুগন্ধি ছায়ার সঙ্গে, সেখানে টেবিল কখনো বিভক্ত নয় — বরং সবার জন্য উন্মুক্ত।এই সেই শহর, যেখানে প্রতিটি খাবার ঐতিহ্য ও আশার গল্প বয়ে নিয়ে চলে।