শান্তি প্রিয় রায়চৌধুরী
জীবন কখনো কখনো সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। সময় কখনো দেয় দুই হাত ভরে, যা থাকে ভাবার বাইরে। তবে ঈর্ষণীয় সাফল্য এমনি এমনি ধরা দেয় না। এর পেছনে থাকে অধ্যবসায়, কঠোর পরিশ্রম। তাহলেই লেখা যায় নতুন ইতিহাস। ঠিক তেমন কিছু এবার মহিলা বিশ্বকাপে করে দেখালেন জন মজুর পরিবারের মেয়ে ক্রান্তি গৌড়। এই জন মজুর পরিবারের মেয়ে এখন বুন্দেলখন্ডের ছোট শহর ঘুয়ারা ছাপিয়ে গোটা ভারতের গর্বের মেয়ে! ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ী ক্রান্তি গৌড় প্রমাণ করেছেন, প্রবল ইচ্ছা ও সংগ্রাম থাকলে যে কোনো প্রতিকূলতাকেই দমিয়ে রেখে সাফল্য পাওয়া যায়।
জন মজুর পরিবারের সাত ভাই-বোনের মধ্যে ক্রান্তিই সবার ছোট। বাবা পুলিশ বিভাগে চাকরি করতেন একসময়। তখন কিন্তু ক্রান্তির পরিবারের অবস্থাটা খুব একটা খারাপ ছিল না। কিন্তু কয়েক বছর আগে চাকরি হারান তিনি। এরপরই দূর্দশা বাড়ে। পেনসন পাননি। যেটুকু জমান টাকা পেয়ে ছিলেন তা খরচ হয়ে গেছে সংসারের খরচ এবং মেয়েদের বিয়েতে। ফলে পরিবারের আর্থিক কষ্ট মেটাতে ক্রান্তির বাবা ও ভাইয়েরা কেউ দিনমজুর, কেউ আবার বাসের কন্ডাক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন। এমন দুরবস্থার মধ্যেও ক্রান্তির মনে ব্যাট-বলের ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র ছেদ পড়েনি। এই অবস্থা থেকে লড়াই চালিয়ে ক্রান্তি হাতে তুলে নিয়েছে বিশ্বকাপের ট্রফি, যেটা ভারতের মহিলাদের ইতিহাসে প্রথম।
খেলার ময়দানে ও বিজয়ের পরবর্তী মুহূর্তে ক্রান্তি গৌড়
নভি মুম্বাইয়ের ডি ওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে গত রবিবার হারমানপ্রীত কৌরের দলের ইতিহাস লেখার পেছনে যে কয়েকজনের অবদান সবচেয়ে বেশি, তাদের মধ্যে ক্রান্তির নামটা আলাদাভাবেই নিতে হবে। দীপ্তি শর্মা, শেফালি বার্মা, স্মৃতি মান্ধানা, জেমিমা রদ্রিগেজদের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারলেও ক্রান্তি যা করেছেন, আক্ষরিক অর্থে সেটাও অনেক কিছু। এমনটাই বলছেন ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা।
ফাইনালের দিন গোটা ভারতের নজর ছিল টিভির পর্দার সামনে। পিছিয়ে ছিলেন না মধ্য প্রদেশের ঘুয়ারার বাসিন্দারাও। ঘরের মেয়ে ক্রান্তির খেলা দেখার জন্য সেদিন ঘুয়ারা উৎসবের নগরীতে রূপ নিয়েছিল। সেদিন খেলা দেখার জন্য ঘুয়ারার বিভিন্ন জায়গায় এলইডি স্ক্রিনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ভারতের জয় নিশ্চিত হতেই ঢোল বাজিয়ে, আতশবাজি ফুটিয়ে, নেচেগেয়ে হয়েছিল শিরোপা উদ্যাপন। ক্রান্তির ছবিও ছিল সেই উদযাপনে। আর সেদিন খেলা শেষে মেয়ের হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি দেখে ক্রান্তির বূদ্ধ বাবা মা আনন্দে ফেলেছেন চোখের জল।
কোচ রাজীব বিলথারের সঙ্গে ক্রান্তি গৌড়
ক্রান্তির সফলতার গল্পটা যেন সিনেমার স্ক্রিপ্টের মতো। যার শুরুতেই আছে নাটকীয়তা। যে গল্পে কুড়িয়ে পাওয়া সুযোগ কাজে লাগিয়ে নায়কের ভূমিকায় আজ ক্রান্তি। ক্রান্তির ক্রিকেটারের শুরুটা হয়েছিল টেনিস বলের ক্রিকেট দিয়ে। একদিন এক ম্যাচে একজন খেলোয়াড় কম থাকায় একাদশে সুযোগ পেয়ে যান ক্রান্তি। সেই ম্যাচে পেয়েছিলেন সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার।আর সেই ম্যাচে দর্শকের আসনে ছিলেন ছএপুর জেলা ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের কোচ এবং সচিব রাজীব বিলথ্রে। তিনি তাকে ছএপুর ক্রিকেট একাদেমিতে ভর্তি করে দেন। এরপর অল্প সময়ের মধ্যে ক্রান্তি মধ্য প্রদেশ মহিলা ক্রিকেট দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০২৪ সালে প্রথমবার মধ্যপ্রদেশকে আঞ্চলিক ওয়ানডে শিরোপা জেতাতে দলকে বল হাতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এরপর একে একে নিজেকে প্রমাণ করে ক্রান্তি আজ গলির মঞ্চ থেকে পৌঁছে গেছেন বিশ্ব মঞ্চে। এখন ক্রান্তি মধ্য প্রদেশের বুন্দেলখন্ড ছাপিয়ে গোটা দেশের নায়ক হয়ে গেছেন।
মধ্যপ্রদেশের হয়ে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য উইমেন্স প্রিমিয়ার লিগে খেলার সুযোগ পান ক্রান্তি। ১০ লাখ টাকায় তাঁকে কিনে নেয় ইউপি ওয়ারিয়র্স। এই দলের হয়ে দারুণ বোলিংয়ে নজর কেড়ে প্রথমবারের মতো ডাক পান ভারতের মহিলা দলে। সুযোগ পেয়ে জাতীয় দলের ইংল্যান্ড সফরে সাড়া ফেলে দেন ক্রান্তি। চেস্টার লের বিরুদ্ধে ৫২ রানে ৬ উইকেট নিয়ে উঠে আসেন খবরের শিরোনামে। এরপরের গল্পটা তো সবারই জানা।
বিশ্বকাপ জয়ের পরবর্তী মুহূর্তের একটি ছবি
বিশ্বকাপেও নিজেকে প্রমাণ করেন আলাদাভাবেই। টুর্নামেন্ট জুড়ে ৮ ম্যাচে তাঁর শিকার ৯ উইকেট। ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে ভারতের মহিলা ক্রিকেটের যে নতুন ইতিহাস রচিত হলো, এর শুরুর দিকেই ছিল পাকিস্তান বধের আনন্দ। লিগ পর্বে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে প্রতিবেশী দেশকে ৮৮ রানে হারায় ভারত। সে ম্যাচে ১০ ওভার বল করে মাত্র ২০ রানে প্রতিপক্ষের ৩ ব্যাটারকে ফেরান ক্রান্তি। জেতেন ম্যাচসেরার পুরস্কার।
ভারতের ইতিহাস রচনার সারথি হয়ে নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন ক্রান্তি। তার সফলতায় সবচেয়ে খুশি হয়েছে পরিবার। পরিবারে বইছে আনন্দের বন্যা। ঘুয়ারার দুই কক্ষের ভাঙাচোরা বাড়িটা এবার আরো ভালো হবে। তাই মেয়ের হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি দেখে সেই বাড়িতে বসে আনন্দে কেঁদেছেন বৃদ্ধ মা-বাবা। আজও তাদের চোখে মুখে বিস্ময়।আর দর্শনার্থী এবং সংবাদমাধ্যমের সামনে বোনকে নিয়ে কথা বলছেন গর্বে ফেটে পড়া ক্রান্তির ভাই-বোনেরা।