ভূপেন হাজারিকার সুরে লুইতের চেতনা

Story by  Pulin Deka | Posted by  Aparna Das • 2 d ago
ড. ভূপেন হাজরিকা
ড. ভূপেন হাজরিকা
 
  পুলিন ডেকা

বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী, ভারতরত্ন ড. ভূপেন হাজরিকার বিশাল সৃষ্টিশীলতার মহাসমুদ্রে সংগীত ছিল এক সহজ, প্রাণময় প্রকাশ। ইতিহাস ও বাস্তববোধ, মানবতা ও প্রকৃতি, জাতিগত ঐক্য, বিশ্বপ্রেম-জাতিপ্রেম-স্বজাতিপ্রেম, দরিদ্র মানুষের মুক্তির সংগ্রাম, তরুণ প্রজন্মকে স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে গড়ে তোলা, সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে তিনি তাঁর শিল্পসাধনায় আলোকিত করেছিলেন। সংগীত ছিল তাঁর জীবনের অমৃতসুধা।  
 
তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে এক রূপান্তরশিল্পী। মানুষের মননশীলতার প্রকাশ ঘটিয়ে জীবনের সৌন্দর্যের সন্ধান করেছিলেন। কিন্তু প্রকৃতির প্রতি তাঁর ছিল গভীর সংবেদনশীলতা। সেই সংবেদনই প্রকাশ পেয়েছিল ব্রহ্মপুত্র বা লুইতে। লুইতকে তিনি সংগীতের প্রাণবন্ত প্রবাহে রূপান্তরিত করে জাতীয় আবেগের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিলেন, যা অসমের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়। বিশ্বসংস্কৃতির সংগীতযাত্রায় নদী কেবল প্রাকৃতিক শক্তিই নয়, মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা, জীবনদর্শন ও রূপান্তরের পটভূমি। সংগীতে নদী কখনও প্রতীক, কখনও রূপক। তাই নদীকেন্দ্রিক সুরের ধারায় শিল্পপ্রেমীরা আজও আপ্লুত।  
 
ড. ভূপেন হাজারিকার মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতিকৃতিতে  শ্রদ্ধাঞ্জলী জানানোর একটি দৃশ্য
 
ব্রুস স্প্রিংস্টিনের ‘দ্য রিভার’ অ্যালবামে নদীকে আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষের জীবন, স্বপ্ন ও সংগ্রামের জীবন্ত প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। গানটির কেন্দ্রে আছে নদী এবং তার মধ্যকার গভীর অর্থবোধকতা, অতীতের প্রতি আকর্ষণ ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা। কৈশোরের আশাবাদিতা এবং প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের কঠিন বাস্তবতা এখানে একাকার হয়ে গেছে।  
 
পেনসিলভানিয়ার ইস্পাত কারখানার শ্রমিকদের উৎসর্গীকৃত গানগুলোতে অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের চিত্র দেখা যায়। পাশ্চাত্য সংগীতে নদীকে অনেক সময় মানুষের অভ্যন্তরীণ অনুভব, যাত্রা ও সামাজিক প্রভাবের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে। ‘দ্য রিভার’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এক সামাজিক সংগীত আন্দোলনের রূপ নেয়। নদী এখানে স্মৃতির মতো, হাহাকারের মতো, সংগীতের মতো বহমান। ষাটের দশকের আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দা সেই আবেগকে আরও ঘনীভূত করেছিল।  
 
নদী কেবল জলপ্রবাহ নয়; এ জীবন, পুনর্জন্ম, ক্ষমা ও গভীর মানবিকতার প্রতীক। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নদী সাহিত্য, ধর্ম ও সংগীতে এক জীবন্ত প্রতীকেরূপে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ‘টেক মি টু দ্য রিভার’ গানে নদী হয়ে উঠেছে মানসিক ও আধ্যাত্মিক প্রশান্তির উৎস। এ. আই. গ্রিনের মূল সংস্করণে গসপেলের গভীর প্রভাব দেখা যায়, আর ‘টকিং হেডস’-এর সংস্করণে আছে পরীক্ষামূলক নিউ ওয়েভ সুর। দুটি সংস্করণই একই মূল ভাবনাকে ভিন্নভাবে বিকশিত করেছে।  
 
ড. ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে জুবিন গার্গ ও মানস রবীন
 
‘টেক মি টু দ্য রিভার, ড্রপ মি ইন দ্য ওয়াটার, ওয়াশ মি ডাউন’, এই পংক্তিগুলো শুধু শব্দ নয়, এক আত্মিক আকুলতা; পুনর্জাগরণের, নতুন শুরুর আহ্বান। সংগীতে নদী জীবন ও মৃত্যুর প্রতীক, পরিবর্তনের পথ, আধ্যাত্মিক সমন্বয় ও প্রেরণার চিরন্তন উৎস।  
 
বিশ্বসংগীতে নদী যে তাৎপর্য বহন করে, তারও ঊর্ধ্বে গিয়ে ড. ভূপেন হাজরিকা লুইতের প্রাণময় সত্তাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। তাঁর কাছে লুইত ছিল কেবল স্বপ্ন নয়, জীবন্ত বাস্তব, যা বহন করে আসামের মানুষের যাত্রাপথ। ‘মহাবাহু ব্রহ্মপুত্র’ গানে তিনি ইতিহাসকে ধারণ করে নতুন জীবনের বার্তা দিয়েছেন, ঐক্য ও মানবতার গভীর আহ্বান জানিয়েছেন: 
 
“স্বকীয় রূপ লৈ ব’হাগনো আহে ক’লৈ?  
ব্ৰহ্মপুত্ৰর দুই পারলৈ নহয় জানো?”  
 
হাজরিকা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, অসমিয়া সংস্কৃতির প্রাণশক্তি হলো ব্রহ্মপুত্র। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন জাতি ও জনগোষ্ঠী লুইতের দুই তীরে মিশে গড়ে তুলেছে মিলনের কেন্দ্র। এই নদী চেতনা ও ঐক্যের ক্ষেত্র। ভূপেন হাজরিকা ইতিহাসকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলেন, তিনি বুঝেছিলেন, ব্রহ্মপুত্রই অসমিয়া সভ্যতার মূল ভিত্তি।  
 
মহম্মদ রফির সঙ্গে ড. ভূপেন হাজারিকার একটি ছবি
 
অসমের প্রতি মানুষের আকর্ষণ এই ব্রহ্মপুত্র থেকেই। দূর কান্যকুব্জ থেকে আগত বারভূঞার বংশে শঙ্করদেবের জন্ম, মরুভূমির দেশ থেকে আসা আজান ফকিরের জিকির, দিল্লির দিলওয়ারের অঙ্কিত হস্তলিখিত পুঁথি, পঞ্চনদের দেশের বাহাদুরের আধ্যাত্মিক দর্শন, সবই ব্রহ্মপুত্রের গতিশীলতার সাক্ষ্য।  
 
লুইত ভূপেন হাজরিকার কাছে আত্মিক প্রেরণার উৎস। ব্রহ্মপুত্রের শক্তিতে জাতি জাগ্রত হোক, এই ছিল তাঁর স্বপ্ন। কিন্তু সমাজের অবক্ষয় দেখলে তাঁর অভিমানী মন কেঁপে উঠত। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন:  
 
“বিস্তীর্ণ পাররে 
অসংখ্য জনরে  
হাহাকার শুনিও  
নিঃশব্দে নীরবে বুঢ়া লুইত তুমি  
বুঢ়া লুইত বোয়া কিয়?”  
 
রাষ্ট্রপতি পুরস্কার গ্রহণ করার মুহূর্তে ড. ভূপেন হাজারিকা
 
যে লুইত মানবতার শিক্ষা দিয়েছে, ঐক্যের সেতু গড়েছে, সেই লুইতও এখন নীরব। নৈতিকতার অবক্ষয়, মানবতার পতন তাকে নির্বাক করেছে। সেই বেদনা থেকেই তাঁর শিল্পীমন বিদ্রোহ করেছে:  
 
“পানীর পারতে জনম আমার 
পানীয়েই পিতৃ শক্তি আমার  
সেই শক্তিরে বানক রুধিম  
সহস্ৰ হাতেরে দুপার বান্ধিম।”  
 
‘লুইতর পার দুটি’ গানে তিনি আলোক দেখেছিলেন, জ্ঞান ও ঐক্যের দীপে উজ্জ্বল হবে দুই তীর। কিন্তু বন্যার ধ্বংস দেখে তিনি আবার উদ্বিগ্ন। তাঁর আহ্বান, আসামবাসী যেন ব্রহ্মপুত্রকে রক্ষা করে, ধ্বংস থেকে সৃষ্টির দিকে নিয়ে যায়। ‘আজি ব্রহ্মপুত্র হ’ল বহ্নিমান’ গানে তিনি জাতির সংগ্রামী চেতনাকে প্রকাশ করেছেন।  
 
ভূপেন হাজরিকা যেভাবে ব্রহ্মপুত্রকে বিশ্বমানবতার সামনে তুলে ধরেছেন, তা আসামের ইতিহাসে এক সোনালি অধ্যায় হয়ে থাকবে।  
 
(লেখক একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক। আজ সুধাকণ্ঠ ভূপেন হাজরিকার চতুর্দশ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এই প্রবন্ধটি প্রকাশ করা হলো।)