আধুনিক দাসত্ব কোনো ইতিহাস নয়, এটা আজও ঘটছে, আমাদের চারপাশেই

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 5 d ago
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি
 
ওয়াইস সাকলাইন আহমেদ 

শিশুটি ছিল ‘বেবি জেন ডো’, তার নিজের ইচ্ছায় নয়, বরং তার পরিচয়টুকুও তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল বলে। ইন্দোনেশিয়ার এক গৃহকর্মীকে নিউ ইয়র্কের এক বিলাসবহুল ম্যানহাটন অ্যাপার্টমেন্টে একটি প্রভাবশালী পরিবার নির্মম দাসত্বে আটকে রেখেছিল। তার পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, দিনে ১৬ ঘণ্টা কাজ করানো হতো, আর প্রায় কিছুই পারিশ্রমিক দেওয়া হতো না, চোখের সামনে লুকিয়ে থাকা আধুনিক দাসত্বের এক নৃশংস চিত্র। একসময় সে পালিয়ে যায়, নিরাপত্তা পায় এবং অভিযোগ করে। কিন্তু সামনে উপস্থিত হয় আরেকটি দেয়াল, তার নির্যাতনকারীরা, প্রাক্তন কূটনীতিক মিশাল আল-হাসান ও তার স্ত্রী, কূটনৈতিক সুরক্ষার আড়ালে ছিলেন।
 
এই একটি ঘটনা আসলে এক মহামারির ক্ষুদ্রতম প্রতিচ্ছবি, এক লুকোনো শ্রমবাজার, যেখানে কথায় আর কাজে ফারাকটি সবচেয়ে বেশি। এটাই সেই অদৃশ্য অর্থনীতির বাস্তবতা, যেখানে বর্তমানে ২৭.৬ মিলিয়ন মানুষ জোরপূর্বক শ্রমে আটকে আছে, যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি পাচার হয়ে গৃহস্থালী শ্রমে বাধ্য করা হয়।শুধু গৃহস্থালী কাজে এই হিংস্র শোষণ বছরে প্রায় ২.৬ বিলিয়ন ডলারের অবৈধ মুনাফা তৈরি করে। বিশ্বব্যাপী জোরপূর্বক শ্রম থেকে তৈরি হয় ২৩৬ বিলিয়ন ডলার, দুর্বল মানুষের পিঠের উপর দাঁড়ানো একটি অন্ধকার অর্থনীতি।
 
প্রতীকী ছবি
 
কিন্তু প্রশ্ন হলো, যখন ক্ষমতা ও অবস্থান ন্যায়বিচারকে অস্বীকার করে, তখন আমাদের প্রকৃত মূল্য কী দিয়ে নির্ধারিত হয়? আমরা আধুনিক দাসত্ব নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসি, যেন এটি ইতিহাস। কিন্তু তা নয়। এটি আজও ঘটছে, বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের ভিতরে। এই পরীক্ষা, যা প্রায় ১,৪০০ বছরের পুরোনো, মাপা হয় প্রভাব দিয়ে নয়, বিবেক দিয়ে।
 
প্রতি ১০ ডিসেম্বর, আমরা মানবাধিকার দিবসে ন্যায়বিচারের পোস্টার শেয়ার করি, তারপর বাড়ি ফিরে যাদের দিয়ে আমাদের ঘর পরিষ্কার করাই, তাদেরই বলি দেরি পর্যন্ত কাজ করতে, এমনকি জিজ্ঞেসও করি না তারা খেয়েছে কি না।
 
১৪ শতাব্দী আগে, নবী মুহাম্মদ (সা.) মদিনার বাজারে সালমান আল-ফারিসিকে খেজুর গাছের ডাল বয়ে নিয়ে যেতে দেখেন। সালমান তখন স্বাধীন ছিলেন না, বাঁধা শ্রমে আবদ্ধ ছিলেন, এমন বোঝা বহন করতেন যা অনেকের পক্ষে অসম্ভব। নবী (সা.) কোন বক্তৃতা দিলেন না। তিনি কিছু ডাল তুলে নিজেই বহন করতে শুরু করলেন। সালমানের মালিক খবর পেয়ে রেগে গেল। বলল, “আপনি আমার দাসকে সাহায্য করলেন?” উত্তর ছিল সহজ,“চুক্তিতে সে তোমার দাস; মানবতায় সে তোমার ভাই।” কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সালমান স্বাধীন হন। পরবর্তীতে তিনি ইসলামের প্রথম যুগের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বদের একজন হয়ে ওঠেন।
 
প্রতীকী ছবি
 
কুরআন স্পষ্ট করে বলে, “হে মানবজাতি! নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক নারী ও এক পুরুষ থেকে, এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরকে জানতে পারো। নিঃসন্দেহে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই সবচেয়ে সম্মানিত যে সবচেয়ে পরহেজগার।” (৪৯:১৩) “পদবি তোমার মূল্য নির্ধারণ করে না, চরিত্র করে।”
 
২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপে, মোহাম্মদ সালাহ একটি টি-শার্ট পরেছিলেন যাতে লেখা ছিল, “Stand with workers' rights.” সঙ্গে সঙ্গে সমালোচনা শুরু হল, “খেলায় থাকো”, “রাজনীতি বন্ধ করো।” কিন্তু সালাহ জানতেন সেই অভিবাসী শ্রমিকদের কথা, যারা সেই স্টেডিয়ামগুলো বানিয়েছিল, তাদের মৃত্যু, মজুরি চুরি, পাসপোর্ট আটকে রাখা। পরে তিনি বলেছিলেন, “আমার দাদা রাজমিস্ত্রি ছিলেন। তার অধিকার যদি রক্ষা না করা হতো, তবে যত নামাজই পড়তাম, তা ঠিক হতো না।”
 
নবী (সা.) বলেছেন, “অত্যাচারের বিরুদ্ধে নীরবতা তোমাকে অত্যাচারীর সঙ্গী বানায়।” ইসলামের প্রথম সংবিধান কোনো নামাজের সূচি নয়। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে রচিত মদিনা সনদ ছিল আসলে এক শ্রম-অধিকার সনদ।
১৫ নম্বর ধারায় বলা ছিল, “শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি প্রদান করা হবে।” ২৩ নম্বর ধারায় লেখা, “কোন শ্রমিককে তার সামর্থ্যের বাইরে কাজ দেওয়া যাবে না, এবং তার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা যাবে না।”
 
একবার এক ধনী ব্যবসায়ী শ্রমিকদের মজুরি দিতে দেরি করছিল। নবী (সা.) ভোরবেলা তার বাড়িতে গেলেন। বললেন, “তুমি রেশমে ঘুমাও অথচ যারা তা অর্জন করেছে তারা দুশ্চিন্তায়?” সেই সকালেই মজুরি পরিশোধ করা হয়।
 
প্রতীকী ছবি
 
আজ উপসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় ২৪ লাখ গৃহকর্মী শ্রম দেন। তাঁদের অনেকেই দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার নারী, যারা বহু বছর পরিবারকে দেখতে পারেননি। আইশা দুবাইতে কাজ করে। সে বাংলাদেশ থেকে গেছে। তার পাসপোর্ট নিয়েছে মালিক, আইনবিরুদ্ধ, কিন্তু সে কার কাছে যাবে? দিনে ১৬ ঘণ্টা কাজ। সাপ্তাহিক ছুটির দাবি করলে মালিক বলল, “তোমার ধর্ম তো ধৈর্য শেখায়, তাই না?” কারও ধর্মকে শোষণের হাতিয়ার বানানো ইসলাম নয়। এটা ধর্মের নামে নিষ্ঠুরতা।
 
একবার নবী (সা.) দেখলেন তার স্ত্রী একজন গৃহকর্মীকে ভাঙা থালার জন্য বকাঝকা করছেন। তিনি থামিয়ে দিলেন, “তুমি কি চাও কেউ তোমার মেয়েকে এভাবে বকুক যখন সে ভুল করবে?” তারপর কর্মীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “যা ভাঙা গেছে তার মূল্য আছে। কিন্তু যে কথায় ভাঙা যায়, তোমার মর্যাদা, তার মূল্য অমূল্য।”
 
সত্য হলো, সাংস্কৃতিক অভ্যাস সবসময় ইসলামি নীতি নয়। নারীকে আটকে রাখা ‘সংস্কৃতি’, ইসলাম নয়।বিদেশি বলে কম মজুরি দেওয়া অর্থনৈতিক শোষণ। “আমরা টাকা দিই” বলে বিশ্রাম না দেওয়া হলো বেতনের আড়ালে আধুনিক দাসত্ব।
 
নবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, প্রকৃত মুমিন কাকে বলে? উত্তরে তিনি অনুসারীর সংখ্যা বা দৃষ্টিনন্দন আচরণের কথা বলেননি। বলেছিলেন, “তাকে, যে তাদের ভালভাবে আচরণ করে যারা তার জন্য কিছুই করতে পারে না।”
 
প্রতীকী ছবি
 
প্রকৃত সংহতি মানে শুধু “আমাদের লোকদের” রক্ষা করা নয়, বরং নিজের ঘরে থাকা অবিচারকেও স্বীকার করা। বিদেশের অন্যায় নিয়ে পোস্ট করা নয়, বরং নিজের রান্নাঘরের অন্যায় বন্ধ করা। আপনার বাড়ির মেঝে যে ব্যক্তি পরিষ্কার করছে, সে আপনার মতোই আল্লাহর সৃষ্ট সত্তা, এই সত্যটুকু স্বীকার করাই আসল।টেক্সটগুলো স্পষ্ট। ইতিহাস নথিভুক্ত। কুরআনের বাণী সুস্পষ্ট।
 
নবী (সা.) সালমানকে মুক্ত করেছিলেন ট্রেন্ডিং ছিল বলে নয়, সেটা সঠিক ছিল বলে। সালাহ কথা বলেছিলেন ব্র্যান্ডের জন্য নয়, কারণ তার নীরবতা তার বিবেককে মেরে ফেলত। ইসলামে মানবাধিকার জটিল নয়; শুধু তাদের জন্য ‘অসুবিধাজনক’ যারা চোখ ফিরিয়ে রাখতে চায়।
 
এই মানবাধিকার দিবসে, অন্য কোথাও অন্যায় নিয়ে পোস্ট করার আগে চারপাশ দেখুন, আপনার আশপাশে কি এমন কেউ আছেন যাঁর নাম আপনি জানেন না, কিন্তু যার শ্রমের উপর আপনার জীবন চলে? তার নাম জানুন। তার পরিবারের খোঁজ নিন। সময়মতো মজুরি দিন। যথাযথ বিশ্রাম দিন। যেমন আচরণ আপনি নিজের সন্তানের জন্য চাইতেন, তেমন আচরণ তাদের সঙ্গে করুন। আপনার ঈমান প্রমাণিত হয় না কত রাকাত নামাজ পড়েন, বরং কেমন আচরণ করেন তাদের সঙ্গে যাদের আপনার প্রতি নির্ভর করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
 
(লেখক একজন এভিয়েশন পেশাজীবী।)