পেইন্টার জিলানি: মানবতার রঙে আঁকা এক জীবন

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 2 d ago
পেইন্টার জিলানি
পেইন্টার জিলানি
 
জেব আখতার / রাঁচি  

ঝাড়খণ্ডের পালামু জেলার অরণ্যঘেরা পাহাড়ি জনপদ বহুদিন ধরেই অবহেলা ও বঞ্চনার প্রতীক হয়ে আছে। সেই দুর্গম প্রান্তেই বাস করেন সত্তার খলিফা, যিনি ‘পেইন্টার জিলানি’ নামে অধিক পরিচিত, একজন মানুষ, যিনি নিজের শিল্প, সাহস আর মানবিকতায় প্রমাণ করেছেন যে কঠিন বাস্তবতার মাঝেও আশার রঙ ফুটিয়ে তোলা যায়। 
 
জিলানির শৈশব কেটেছে অভাব ও কষ্টে। অল্প বয়সে পিতৃহারা হয়ে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়েছিল তাঁকে। প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও তিনি স্নাতক পর্যন্ত পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। তবে তাঁর প্রকৃত আকর্ষণ ছিল মানুষের সেবায়, পড়াশোনায় নয়।
 
সচেতনতামূলক প্রচারণার সময় পেইন্টার জিলানি
 
নামের মতো তিনি শুধু শিল্পী নন, একজন সমাজকর্মীও। পেশায় তিনি একজন চিত্রশিল্পী, এবং তাঁর উপার্জনের প্রায় পুরোটাই তিনি ব্যয় করেন দরিদ্র মানুষের সাহায্যে। তিনি বলেন, “শিল্প আমার হাতিয়ার, সেবা আমার উদ্দেশ্য।” 
 
জিলানির সততা ও সাহসের জন্য তিনি এক অনন্য মর্যাদা অর্জন করেছেন। এমনকি নকশাল ও উগ্রবাদী প্রভাবের চরম সময়েও তিনি নির্ভয়ে বিশ্রামপুর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের জেলাশহর ডালটনগঞ্জ পর্যন্ত যাতায়াত করতেন। কখনো নকশাল বা উগ্রবাদীরা তাঁকে বাধা দেয়নি, এটাই তাঁর চরিত্রের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ।  
 
সামাজিক কর্মব্যস্ততার মধ্যে পেইন্টার জিলানি
 
পালামু ও গড়ওয়ার দরিদ্র, দলিত, মহাদলিত ও প্রান্তিক মানুষের কাছে জিলানি এক আশ্বাসের নাম। রেশন কার্ড, পেনশন, পানীয় জল, হাসপাতালের সাহায্য, সব ক্ষেত্রেই তিনি পাশে থাকেন। এখন পর্যন্ত তিনি ৫০০-রও বেশি মানুষকে রেশন কার্ড পেতে সাহায্য করেছেন এবং প্রায় সমসংখ্যক পরিবারকে পেনশন প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। নিজের অভাবের মধ্যেও তাঁর আনন্দ আসে তখনই, যখন কোনো প্রবীণ বা প্রতিবন্ধী মানুষ প্রথমবারের মতো তাঁদের পেনশন পান, এটাই তাঁর কাছে প্রকৃত বিজয়।  
 
কয়েক মাস আগে নগর পরিষদ এলাকার শতাধিক প্রবীণ, বিধবা ও প্রতিবন্ধী মানুষ চার মাস ধরে পেনশন পাচ্ছিলেন না। প্রশাসনের কাছে আবেদন করে ফল না পেয়ে তাঁরা আশ্রয় নেন জিলানির কাছে। প্রশাসনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ ব্যর্থ হলে তিনি অনির্দিষ্টকালের অনশন শুরু করেন। তাঁর দৃঢ় সংকল্পের ফলেই সরকার বকেয়া পেনশন মঞ্জুর করে।  
 
পেইন্টার জিলানির উদ্যোগে আয়োজিত সামাজিক আন্দোলনে গ্রামবাসীরা
 
প্রতিটি গ্রীষ্মেই বিশ্রামপুরে জলের সংকট দেখা দেয়। বিকল হ্যান্ডপাম্প ও অপর্যাপ্ত ট্যাঙ্কার সরবরাহ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। জিলানি আন্দোলন সংগঠিত করেন, হ্যান্ডপাম্প মেরামত করান এবং ট্যাঙ্কার সরবরাহ নিশ্চিত করেন, যতক্ষণ না স্থায়ী সমাধান হয়। তাঁর সক্রিয়তা এখানেই থেমে থাকেনি, তিনি নিজেই একটি মানচিত্র এঁকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জমা দেন, যাতে বিশ্রামপুরকে উপবিভাগীয় সদর দফতর হিসেবে ঘোষণার দাবি জানানো হয়।  
 
পালামুর রেশন বিতরণ ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতিগ্রস্ত। ন্যায্যমূল্যের দোকানদাররা প্রায়ই দরিদ্রদের ঠকাত। জিলানি সরাসরি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে নামেন, বিক্ষোভ সংগঠিত করেন এবং নিশ্চিত করেন যেন মানুষ তাঁদের প্রাপ্য রেশন পান। এখন এলাকার রেশন ডিলাররা জানেন, অন্যায় হলে ‘পেইন্টার জিলানি’র নজর পড়বে। সরকারি হাসপাতালে অবৈধ ফি নেওয়ার বিরুদ্ধেও তিনি লড়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রসবের জন্য ৪,০০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হতো। জিলানি বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন, দুর্নীতি প্রকাশ্যে আনেন এবং তা বন্ধ করতে সক্ষম হন। আজ এলাকায় এমন শোষণ প্রায় বন্ধ।  
 
জলের অভাবের মুখোমুখি গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলাকালীন পপেইন্টার জিলানির একটি ছবি
 
তাঁর নিরলস প্রচেষ্টার স্বীকৃতি স্বরূপ সম্প্রতি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা (শহর) প্রকল্পের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই পদে তিনি প্রকল্প সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ান এবং যাঁরা এখনও সুবিধা পাননি, তাঁদের অন্তর্ভুক্তির জন্য কাজ করেন, এটি তাঁর এবং বিশ্রামপুরের জন্য গর্বের মুহূর্ত।  
 
নির্বাচনের সময় রাজনীতিবিদরা ভোট চাইতে এলে জিলানি মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেন যে প্রকৃত উন্নয়ন শুরু হয় পঞ্চায়েত ও ওয়ার্ড স্তর থেকে। তাঁর অবিরাম তৎপরতায় অনেক হ্যান্ডপাম্প মেরামত হয়েছে, পানীয় জলের সরবরাহ বেড়েছে। এখন তাঁর প্রভাব পালামুর গণ্ডি ছাড়িয়ে গড়ওয়া পর্যন্ত পৌঁছেছে, সেখান থেকেও মানুষ স্বাস্থ্য ও কল্যাণ প্রকল্পের সাহায্যের জন্য তাঁর কাছে আসেন।  
 
একটি পরিবারের সঙ্গে পেইন্টার জিলানি
 
সামাজিক কাজের বাইরে জিলানি একজন কবি, গীতিকার ও পরিবেশকও। তাঁর গান ন্যায়, সমতা ও পরিবর্তনের কথা বলে। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, “আমার হয়তো বড় বড় ডিগ্রি নেই, কিন্তু মানুষের কষ্টই আমার সবচেয়ে বড় পাঠ্যবই।” 
 
পালামু ও বিশ্রামপুরের মতো অঞ্চলে, যেখানে দারিদ্র্যই পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে পেইন্টার জিলানির মতো মানুষরা আশার আলোকবর্তিকা। তিনি প্রমাণ করেছেন, প্রকৃত পরিবর্তন শুধু সরকার বা নেতাদের মাধ্যমে আসে না, বরং শুরু হয় সাধারণ মানুষের অসাধারণ সহানুভূতি ও সাহস থেকে।