গুলি থেকে গণতন্ত্রের পথে: অসমের ২০০৮ সালের বিস্ফোরণ কীভাবে শান্তির নতুন দিশা দেখিয়েছিল

Story by  Pallab Bhattacharyya | Posted by  Aparna Das • 10 h ago
নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বোড়ো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ঐতিহাসিক মুহুর্ত
নয়া দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বোড়ো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ঐতিহাসিক মুহুর্ত
 
  পল্লব ভট্টাচার্য 

২০০৮ সালের ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরণের ভয়াবহতা থেকে অসমের পরিবর্তন, আজ শান্তি ও সমন্বয়ের প্রতীকে রূপান্তরিত হওয়া, আধুনিক ভারতের পুনর্মিলনের অন্যতম আকর্ষণীয় অধ্যায়। ২০০৮ সালের ৩০ অক্টোবরের সেই করুণ দিনে গুয়াহাটি, কোকরাঝাড়, বরপেটা এবং বঙাইগাঁও- এ সংঘটিত নয়টি ভয়ংকর বিস্ফোরণে ৮৮ জন নিহত হয় এবং ৫৪০ জনেরও বেশি মানুষ আহত হন।
 
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট অব বডোল্যান্ডের (এনডিএফবি) রঞ্জন দৈমারী শিবির কর্তৃক সংঘটিত এই ধারাবাহিক বিস্ফোরণ পরবর্তী বছরগুলিতে অনুশোচনা, সংস্কার এবং পুনর্মিলনের এক অধ্যায়ে রূপ নেয়। দেশবাসীর ধৈর্য, সংযম এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নীতি প্রমাণ করে দিয়েছিল, অপরাধীকেও শান্তির অংশীদার করে তোলা সম্ভব।
 
গণেশগুরি ফ্লাইওভারের নিচে বোমা বিস্ফোরণের পরবর্তী দৃশ্য
 
অসম পুলিশ এবং পরবর্তীতে সিবিআই-এর প্রাথমিক তদন্তে বিস্ফোরণের নেপথ্যের শক্তিকে শনাক্ত করা হয়। এনডিএফবির প্রতিষ্ঠাতা রঞ্জন দৈমারীসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার পর দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু একই সময়ে সরকারও তাদের মূলস্রোতে ফেরানোর প্রস্তুতি শুরু করে।
 
এই উদ্দেশ্যে ইউনিফাইড কমান্ড স্ট্রাকচার; প্রশাসন, পুলিশ, সেনা ও আধা-সামরিক বাহিনীকে একত্রিত করে সমন্বিত কাঠামো, আরও শক্তিশালী করা হয়। ভুটানে ২০০৩ সালের “অপারেশন অল ক্লিয়ার”, কোকরাঝাড় ও শোণিতপুরে ২০১৪ সালে ৮৪ জন আদিবাসী হত্যার পর অভিযানের ধারা, এবং ২০১৫ সালে মিয়ানমারে “অপারেশন হট পার্সুইট”, এসব সামরিক পদক্ষেপ উগ্রপন্থীদের দুর্বল করে দেয়। ভুটান, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত-পার সহযোগিতার ফলে বিদ্রোহীদের ঘাঁটিগুলো একে একে ভেঙে যায়। তবে সরকার বুঝেছিল, কেবল বলপ্রয়োগে বিদ্রোহের অবসান ঘটানো যায় না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা গঠন করে এবং অভিজ্ঞ কর্মকর্তা পিসি হালদারকে আলোচক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করে।
 
এক বড় অগ্রগতি আসে ২০১০ সালে, যখন বাংলাদেশ রঞ্জন দৈমারীকে ভারতে প্রত্যর্পণ করে। ২০১৩ সালে তাকে শান্তি আলোচনায় যোগ দিতে শর্তসাপেক্ষ জামিন দেওয়া হয়। সরকার তাকে পরাজিত শত্রু নয়, বরং শান্তির সম্ভাব্য অংশীদার হিসেবে গ্রহণ করে। বহু বছরের আলোচনার ফলস্বরূপ, ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এনডিএফবির সব গোষ্ঠী, অল বোড়ো স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (এবিএসইউ) এবং ইউনাইটেড বোড়ো পিপলস অর্গানাইজেশন (ইউবিপিও)-এর স্বাক্ষরে ঐতিহাসিক বড়ো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটি কেবল রাজনৈতিক নিষ্পত্তিই ছিল না, ছিল এক উন্নয়ন ও পুনর্গঠনের বিস্তৃত নকশা।
 
২০০৮ -এর ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরণের মূল অভিযুক্ত রঞ্জন দৈমারী
 
চুক্তির মাধ্যমে বোড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল এরিয়া ডিস্ট্রিক্ট (বিটিএডি) রূপান্তরিত হয় বোড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল রিজিয়নে (বিটিআর), আরও বেশি ক্ষমতা ও স্বায়ত্তশাসনের সঙ্গে। বড়ো ভাষাকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়, বড়ো মাধ্যমের বিদ্যালয় চালু হয়, এবং প্রকৃত রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এই চুক্তি সংঘাতের মানবিক ক্ষতিকে স্বীকার করে। এতে ছিল ১৫০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্যাকেজ, ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ, এবং প্রাক্তন উগ্রপন্থীদের পুনর্বাসন পরিকল্পনা। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ১৬১৫ জন এনডিএফবি ক্যাডার অস্ত্র সমর্পণ করে, দশকব্যাপী হিংসার অবসান ঘটায়।
 
২০২১ সালের মধ্যে প্রায় ২৮০০ প্রাক্তন উগ্রপন্থীকে জীবিকা সহায়তা ও প্রশিক্ষণসহ পুনর্বাসন করা হয়। অল বোড়ো স্টুডেন্টস ইউনিয়নের মতো অসামরিক সংগঠনগুলোও তরুণ সমাজকে শান্তির পথে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সরকারের আস্থা পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। ২০২২ সালের এপ্রিলে সমগ্র বোড়োল্যান্ড অঞ্চল থেকে সশস্ত্র বাহিনী (বিশেষ ক্ষমতা) আইন, AFSPA; প্রত্যাহার করা হয়, যা ছিল শান্তি ফিরে আসার প্রতীকী পদক্ষেপ। কিছুদিনের মধ্যেই উন্নয়ন প্রকল্পগুলি শুরু হয়, যেখানে আগে বন্দুকের শব্দ ছিল, সেখানে এখন পথ, স্কুল, হাসপাতাল ও শিল্প পার্ক গড়ে উঠছে।
 
এই রূপান্তরের পেছনে ছিল ইউনিফাইড কমান্ড স্ট্রাকচার, যা নিরাপত্তা অভিযান ও প্রশাসনিক উন্নয়নের নিখুঁত সমন্বয় নিশ্চিত করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এই মডেলকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়, প্রমাণ করে যে নিরাপত্তা ও মানবিকতা একসঙ্গে চলতে পারে।
 
ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরণের দিনটির একটি ভয়াবহ ছবি
 
আজ বড়ো চুক্তির অধিকাংশ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়েছে। দূরদর্শী নেতৃত্ব, সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ এবং সুষম নীতি; বোড়োল্যান্ডকে পরিণত করেছে শান্তির প্রতীকে। আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু অঞ্চল এখনও বিদ্রোহ ও প্রতিশোধের চক্রে বন্দী।
 
অসমের এই গল্প তাদের শেখায়, যখন বিচ্ছিন্নতার বদলে আলোচনা হয়, এবং শাস্তির পাশাপাশি পুনর্বাসনের ভারসাম্য রক্ষা করা হয়, তখন কঠোর বিদ্রোহীরাও গণতন্ত্রে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারে। ২০০৮ সালের বিস্ফোরণের পর অসমে  যা ঘটেছিল, তা শুধু আঞ্চলিক সাফল্য নয়, এক সর্বজনীন আশার বার্তা। এটি বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়, হিংসা থেকে শান্তির পথ কঠিন হলেও; দৃঢ়তা, সহানুভূতি ও দায়বদ্ধতা থাকলে তা সম্পূর্ণভাবে সম্ভব।
 
(লেখক: অসম সরকারের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ মহাপরিচালক; প্রাক্তন অসম লোকসেবা কমিশনের চেয়ারম্যান এবং ‘আওয়াজ – দ্যা ভয়েস অসম’-এর মুখ্য কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা)