ভক্তি চালক
মহারাষ্ট্রের সাতারা জেলার করাড শহরে টানা প্রবল বৃষ্টিপাতে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কোয়না নদীর তীরে বন্যার মতো অবস্থা তৈরি হয়, আর এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন সেই সব শিল্পীরা, যারা আসন্ন গণেশোৎসব উপলক্ষে গণেশ মূর্তি তৈরি করছিলেন।
তাদের আশঙ্কা ছিল, শত শত গণেশ মূর্তি আর মাসের পর মাসের কঠোর পরিশ্রম নদীর জলে ভেসে যাবে।
ঠিক তখনই তাদের দুর্দশার খবর ছড়িয়ে পড়ে শহরের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলোতে। এক হৃদয়গ্রাহী দৃশ্যে, হিন্দু ও মুসলিম যুবকেরা একসঙ্গে ছুটে যান সেই স্থানে গণপতি বাপ্পার মূর্তিগুলো রক্ষা করতে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের স্থানীয় কর্মীরা একত্রিত হয়ে শিল্পীদের মাসের পর মাসের পরিশ্রমকে জলে ভেসে যেতে দেননি। একের পর এক মূর্তি তারা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়ে যান। উদ্ধারকারী দলের নেতা মহসিন কাগদি নিজের গুদামঘর খুলে দেন, যাতে সব মূর্তি সেখানে সুরক্ষিতভাবে রাখা যায়।
‘ব্রাদার্স ফাউন্ডেশন’-এর এই নিঃস্বার্থ কাজ আজ সর্বত্র প্রশংসিত হচ্ছে।
সেদিনের ঘটনাটি স্মরণ করে ফাউন্ডেশনের সদস্য জয় সূর্যবংশী বলেন, “২০১৯ সালে করাড ভয়ঙ্কর বন্যার সাক্ষী হয়েছিল। তখন নদীর তীরবর্তী বহু গ্রামের মানুষ বিপদে পড়েছিলেন। এই এলাকায় কুম্ভার (কুমোর) সম্প্রদায়ের মানুষ প্রচুর, যারা ঐতিহ্যগতভাবে মূর্তি তৈরি করেন।
সেই বন্যায় তাদের বহু গণেশ মূর্তি ভেসে গিয়েছিল। বিশাল ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছিল তাদের। তারা পাইকারদের বুক করা মূর্তিগুলো পৌঁছে দিতে পারেননি।”
“এবারও একই পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল,” জয় বলেন। “অবিরাম বৃষ্টির কারণে জলের স্তর দ্রুত বাড়ছিল। বুঝতে পারলাম, ইতিহাস আবারও ফিরে আসতে পারে। তাই আমরা সকলে মিলে ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে মূর্তিগুলোকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দিলাম। আমরা সকলে মিলে কাজ করেছি, হিন্দু ও মুসলিম একসঙ্গে। এটাই আমাদের দলের বিশেষত্ব।”
জয় গর্বভরে বলেন, “আমাদের করাড শহর কখনো ধর্ম বা জাতপাতের রাজনীতির শিকার হয় না। আমরা সকলে মিলেমিশে সম্প্রীতির পথেই চলি, এখানে বৈষম্যের কোনো স্থান নেই। সেই কারণেই আমাদের ফাউন্ডেশনের কোনো সভাপতি নেই; প্রতিটি সদস্যই, যে কোনো ধর্মের হোক না কেন, নিজ নিজ ক্ষেত্রে একজন নেতা।”
যিনি নিজের গুদামঘর খালি করে গণেশ মূর্তিগুলোকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, সেই মহসিন কাগদি জানালেন, “সেদিন কুম্ভার সম্প্রদায়ের বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্যের ফোন পাই। সেখানে প্রায় ৩০০টি মূর্তি ছিল। বড় প্রশ্ন ছিল, সেগুলো কোথায় নিরাপদে সরানো যায়। আমার দোকান কাছেই ছিল, তাই এক মুহূর্তও দেরি না করে সেটি খালি করি এবং শত শত মূর্তি সেখানে রাখতে পারি।”
তিনি আরও যোগ করেন, “আমাদের ব্রাদার্স ফাউন্ডেশন সবসময়ই ধর্মীয় সম্প্রীতি আর সামাজিক সেবার পক্ষে কাজ করে। আমরা ধর্ম বা জাতপাত নিয়ে ভাবি না; আমরা একসঙ্গে কাজ করি। তাই আমি মনে করি না আমরা কোনো অসাধারণ কিছু করেছি। ভবিষ্যতে আবার এমন সুযোগ এলে আমরা সম্মানের সঙ্গেই একইভাবে কাজ করব।”
নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করে মহসিন বলেন, “আমি শুধু চাই, যেন এমন পরিস্থিতি আর না আসে। আমি সরকারের কাছেও আবেদন জানাই যে কুম্ভার সম্প্রদায়কে পর্যাপ্ত আর্থিক সাহায্য দেওয়া হোক, কারণ তারা প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সেদিন প্রবল বর্ষার মধ্যেই তাদের ট্র্যাক্টর আর ক্রেন ভাড়া করতে হয়েছে, যা অনেক টাকাই খরচ হয়েছে। আমাদের বন্ধুমহলও কিছু গাড়ির ব্যবস্থা করেছিল, যা তাদের কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিল।”
ব্রাদার্স ফাউন্ডেশনের আরেকজন মুসলিম কর্মী সামির পাতওয়েকার বলেন, “কুম্ভার সম্প্রদায় বহু বছর ধরে কোয়নার তীরে গণেশ মূর্তি তৈরি করে আসছেন। তাদের কাজ শুরু হয় গণেশোৎসবের পাঁচ-ছয় মাস আগে থেকেই।
এবারও মূর্তিগুলো রঙ করা শেষ হয়েছিল এবং বিক্রির জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু হঠাৎ হওয়া বৃষ্টিতে সবই ঝুঁকির মুখে পড়ে। এর আগেও এমন হয়েছে, আর তাতে শিল্পীরা বিরাট ক্ষতির শিকার হয়েছেন। আমরা শুধু চাইছিলাম, যেন এ বছর আবার তা না ঘটে, আর সবাই আনন্দের সঙ্গে উৎসব পালন করতে পারেন।”
আসলে উৎসবের মূল ভাবনা ছিল সমাজকে একত্রিত করা, যা আজকাল অনেক সময় হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু করাডের এই ঘটনাটি আবারও সেই সত্যিকারের উৎসবের চেতনাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এটি শুধু মূর্তি রক্ষার ঘটনা নয়; এটি ছিল সাতারার সামাজিক বন্ধনকে আরও মজবুত করে তোলার একটি দৃষ্টান্ত, যা প্রমাণ করে মানবতা ও ভ্রাতৃত্ব যেকোনো বিভাজনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করতে পারে।