বিঘ্নহর্তা গণেশ: ২০২৫-এ আবারও দেশ-বিদেশে গর্জে উঠবে “গণপতি বাপ্পা মোরিয়া”

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 2 h ago
প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি
প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি

অনিতা

ভারতবর্ষে উৎসব মানেই ভক্তি, আনন্দ ও মিলনের রঙিন মেলবন্ধন। সেসব উৎসবের মধ্যে বিশেষভাবে পূজিত হয় “গণেশোৎসব” বা “গণেশ চতুর্থী”, যা বুদ্ধি ও সিদ্ধিদাতা ভগবান শ্রীগণেশকে নিবেদিত। এই উৎসব কেবল ধর্মীয় দিকেই নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতেও অসাধারণ তাৎপর্য বহন করে।

২০২৫ সালে দশদিনব্যাপী গণেশোৎসব সারা দেশে আড়ম্বরের সঙ্গে পালিত হবে। ঘরে ঘরে পূজা-অর্চনা, শোভাযাত্রা আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী, ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের চতুর্থীতে গণেশ চতুর্থী পালিত হয়। বিশ্বাস করা হয়, এই মধ্যাহ্নক্ষণে গণেশের আবির্ভাব হয়েছিল। এই বছর ভাদ্র মাসের চতুর্থী তিথি শুরু হবে ২৬ আগস্ট দুপুর ১টা ৫৪ মিনিটে এবং শেষ হবে ২৭ আগস্ট দুপুর ৩টা ৪৪ মিনিটে। উদয়তিথি নিয়ম অনুসারে, পূজা হবে ২৭ আগস্টে, এই দিনেই গণেশ প্রতিমার প্রতিষ্ঠা হবে।
 
গণেশ চতুর্থী
 
পূজার শুভ মুহূর্ত
 
২৭ আগস্ট ২০২৫ তারিখে গণেশ প্রতিমা স্থাপনের সর্বোত্তম সময় সকাল ১১টা ০৫ মিনিট থেকে দুপুর ১টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত। শাস্ত্র মতে, মধ্যাহ্নকালে পূজা করলে বিশেষ ফললাভ হয়, কারণ এই সময়েই গণেশের জন্মকাল ধরা হয়।
 
প্রতিমা প্রতিষ্ঠার নিয়ম
 
গণেশ প্রতিমা আনার আগে গৃহের পূজাস্থল পরিস্কার করে ফুল, রংগোলি ও আলোকসজ্জায় সাজাতে হয়। শুভক্ষণে লাল বা হলুদ বস্ত্র বিছিয়ে তার ওপর প্রতিমা স্থাপন করতে হবে। পূজা শুরুর আগে হাতে জল, ফুল ও অক্ষত নিয়ে সংকল্প করুন। তারপর উচ্চারণ করুন, “ওঁ গণ গণপতয়ে নমঃ”।
 
ভগবান গণেশকে প্রথমে পঞ্চামৃত দিয়ে স্নান করান, পরে নতুন বস্ত্র ও অলংকার পরিয়ে সাজান। তাঁর প্রিয় নৈবেদ্য, মোদক ও লাড্ডু নিবেদন করুন। সঙ্গে দূর্বা দিয়ে, লাল ফুল ও সিঁদুর অর্পণ করা হয়। অবশেষে পরিবার-সহ সবাই মিলে আনন্দে গণেশ আরতির সুর তোলে উৎসবকে পূর্ণতা প্রদান করে।
 
মহারাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত গণেশ চতুর্থীর একটি দৃশ্য
 
মাতা পার্বতী ও গণেশের জন্মকথা
 
গণেশ চতুর্থীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু পুরাণকথা। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ কাহিনি হলো, একদিন দেবী পার্বতী স্নানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। তিনি নিজের দেহের ময়লা থেকে এক শিশুর প্রতিমা গড়ে তাতে প্রাণসঞ্চার করলেন। সেই শিশুই ছিলেন গণেশ। দেবী পার্বতী তাকে আদেশ দিলেন যে, যতক্ষণ না তিনি স্নান সেরে ফিরে আসছেন, ততক্ষণ যেন কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে।
 
এমন সময় ভগবান শিব ফিরে এসে গৃহে প্রবেশ করতে চাইলে গণেশ তাঁকে বাধা দেন। এতে রাগ হয়ে শিব ত্রিশূল দিয়ে গণেশের শিরচ্ছেদ করেন। পার্বতী বিষয়টি জানতে পেরে গভীর শোকে ভেঙে পড়েন এবং শিবকে অনুরোধ করেন গণেশকে পুনর্জীবন দিতে। তখন শিব উত্তর দিকে প্রথম যে প্রাণীটি মেলে তার মস্তক এনে গণেশের ঘাড়ে স্থাপন করেন। সেই প্রানীটি ছিল হাতি। এভাবেই গণেশ নতুন জীবন লাভ করেন এবং পরিচিত হন বিঘ্নহর্তা, সিদ্ধি-বিনায়ক নামে।
 
ইতিহাসে গণেশ চতুর্থী
 
প্রাচীন ঋগ্বেদ, অথর্ববেদ, উপনিষদ ও পুরাণ, সর্বত্রই গণেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। বৈদিক যুগ থেকেই তাঁকে প্রথম পূজ্য দেবতা হিসেবে মানা হয়। আজও শুভকর্ম শুরু হয় “শ্রীগণেশায় নমঃ” উচ্চারণের মাধ্যমে।
 
বিশেষত মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকে গণেশপূজা এক  সাংস্কৃতিক পরম্পরা হিসেবে গড়ে উঠেছে।
 
মহারাষ্ট্রের গণেশ উৎসবের এক ঐতিহাসিক ছবি
 
স্বাধীনতা আন্দোলন ও গণেশোৎসব
 
১৮৯৩ সালে লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক গণেশ চতুর্থীকে জনউৎসবে রূপ দেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল,  ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে মানুষকে একত্রিত করা। এর ফলে গণেশোৎসব সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনার এক শক্তিশালী মাধ্যম হয়ে ওঠে এবং জাতীয় আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। আজও এটি একটি সমবেত সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে পালিত হয়।
 
ধর্মীয় গুরুত্ব
 
গণেশোৎসব শুধু পূজা-পার্বণ নয়, বরং সাংস্কৃতিক ঐক্য ও সামাজিক সম্প্রীতির প্রতীক। ভগবান গণেশকে বিদ্যা, জ্ঞান, সমৃদ্ধি ও বিঘ্ননাশের দেবতা বলা হয়। ঘরে ও প্যান্ডেলে প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করে দশদিনব্যাপী পূজা-অর্চনা হয়।
 
সামাজিক গুরুত্ব
 
সর্বজনীন গণেশোৎসব সমাজকে একসূত্রে বাঁধে। এই সময়ে নাটক, সংগীত, লোককলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানুষের মধ্যে মেলবন্ধনের সেতুবন্ধন গড়ে তোলে।
 
অর্থনৈতিক গুরুত্ব
 
এই উৎসবের সঙ্গে যুক্ত লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা। মূর্তিশিল্পী, সাজসজ্জার ব্যবসায়ী, ফুল বিক্রেতা, শিল্পী,সকলে উপকৃত হন। সাম্প্রতিক সময়ে পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে ইকো-ফ্রেন্ডলি গণেশ প্রতিমার প্রচলন বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রাকৃতিক মাটি ও রঙে গড়া প্রতিমা নদী-সমুদ্রে দূষণ সৃষ্টি করে না।
 
মহারাষ্ট্রে গণেশ প্রতিমা বিসর্জনের একটি দৃশ্য

বিদেশে গণেশ চতুর্থী

 
আজ গণেশোৎসব শুধু ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, মরিশাস, ফিজি ও উপসাগরীয় দেশগুলিতে প্রবাসী ভারতীয় সমাজ উৎসাহের সঙ্গে এই উৎসব পালন করে। এর মাধ্যমে ভারতীয় সংস্কৃতি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
 
২০২৫ সালের তাৎপর্য
 
গণেশ চতুর্থী ২০২৫ হবে কেবল ভক্তির প্রতীক নয়, বরং ভারতীয় সংস্কৃতি, ঐক্য ও সামাজিক জাগরণেরও বহিঃপ্রকাশ। বিশ্বাস করা হয়, ভগবান গণেশের আশীর্বাদ জীবনের সকল বিঘ্ন দূর করে সাফল্য ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে।
 
এই বছরও দেশ-বিদেশে ধ্বনিত হবে, “গণপতি বাপ্পা মোরিয়া, মঙ্গলমূর্তি মোরিয়া!”