শান্তিপ্রিয় রায় চৌধুরী:
অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটা বাস্তব।মুর্শিদাবাদের ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ের ডহপাড়ার কয়েক কিলোমিটার দূরে গ্রাম কিরীটকনা। জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশ। আর এখানেই রয়েছে হিন্দু- মুসলিমদের এক অবিস্মরণীয় কীর্তি কীরিটেশ্বরী মন্দির। এখানে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, যা মনে করিয়ে দেয় পূর্ব গৌরবের স্মৃতিকথা।
কী সেই স্মৃতি কথা?
ধর্মীয় বিশ্বাস মতে, দক্ষযজ্ঞে সতীর কিরীট (মুকুট) পড়ে ছিল এই কিরীট গ্রামে। তাই এই গ্রাম শাক্ত সাধনার অন্যতম স্থল। প্রতিষ্ঠিত দেবী কিরীটেশ্বরী হিসেবে সমাদৃত। বৈষ্ণব ধর্মের অন্যতম পীঠস্থান।
কীরিটেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণ
গ্রামের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম বাসিন্দাদের সাহচর্যে তৈরী হয়েছে হিন্দু ধর্মের এই শক্তিপীঠ। শক্তি পীঠের যে পরিচালন কমিটি আছে তাতে আছে একাধিক মুসলিম সদস্য।
গ্রামের মুকুটে এসেছে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা। কী সেই শিরোপা?
ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রকের তরফ থেকে মিলেছে ‘বেস্ট ট্যুরিজ়ম ভিলেজ অফ ইন্ডিয়া’ খেতাব। দেশের ৭৯৫টি আবেদনের মধ্য থেকে ভারত সেরার শিরোপা আদায় করে নিয়েছে মুর্শিদাবাদের প্রান্তিক গ্রাম কিরীটেশ্বরী। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর দিল্লি থেকে মিলবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন গ্রামের বাসিন্দাদের শুভেচ্ছা:
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর এক্স হ্যান্ডলে লিখেছেন, ‘‘আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার কিরীটেশ্বরীকে ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রক ভারতের সেরা পর্যটন গ্রাম হিসেবে নির্বাচিত করেছে। দেশের ৩১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত ৭৯৫টি আবেদনের মধ্যে ২০২৩ সালের ‘সেরা পর্যটন গ্রাম প্রতিযোগিতা’ হয়েছিল। সেখানেই এই নির্বাচন হয়েছে৷ আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে হবে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান। আমি ওই গ্রামের বাসিন্দাদের অভিনন্দন জানাই। জয় বাংলা!’’
কীরিটেশ্বরী মন্দির প্রাঙ্গণ
মন্দির নিয়ে রয়েছে জনশ্রুতি:
শোনা যায়,পলাশির যুদ্ধের পর যখন মিরজাফর তাঁর অন্যতম সঙ্গী রাজা রাজবল্লভকে ডুবিয়ে মারেন, সে দিন এই মন্দিরের এক শিবলিঙ্গ নাকি নিজে থেকেই ফেটে গিয়েছিল। মিরজাফর শেষ বয়সে কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত হন। তিনি তখন নাকি অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছেন। তাঁর বিশ্বাস জন্মায়, দেবীর চরণামৃত পান করলে তিনি রোগমুক্ত হবেন। দেবীর চরণামৃত যখন তাঁর কাছে পৌঁছয়, তখন সুবে বাংলার নবাব শেষ নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। দেবীর চরণামৃত মুখে নিয়েই নাকি প্রয়াত হন বাংলার ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত চরিত্র মিরজাফর।
এরপর কি হল:
১৪০৫ সালে দেবীর প্রাচীন মন্দিরটি ভেঙে পড়ার পর ১৯ শতকে লালগোলার রাজা দর্পনারায়ণ রায় নতুন করে মন্দিরটি নির্মাণ করেন। এরপর লালগোলার রাজা ভগবান রায়, মুঘল সম্রাট আকবরের থেকে এই মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পান। ভগবান রায়েরই বংশধর ছিলেন দর্পনারায়ণ। দুর্গাপুজো, কালীপুজো ছাড়াও এখানে দেবীর বিশেষ পুজো হয় মাঘ মাসের রটন্তী অমাবস্যায়। পৌষ মাসের প্রতি মঙ্গলবার এখানে একটি বিশেষ মেলা বসে। সেই মেলার সূচনা রাজা দর্পনারায়ণের আমল থেকেই।
প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি
বর্তমানে মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণ করছে হিন্দু-মুসলিম:
মন্দিরের শ্রীবৃদ্ধির দায়িত্ব রয়েছে মন্দির কমিটির উপর। কমিটিতে বেশির সদস্যই মুসলিম। আদপে হিন্দু শাক্ত পীঠস্থান হলেও হিন্দু-মুসলিম ধর্মের সমন্বয়ের অন্যতম দৃষ্টান্ত এই কিরীটেশ্বরী। যে সৌভ্রাতৃত্বের ধারা ঐতিহাসিক সময় থেকে শুরু হয়েছিল, ভাগীরথীর তীরে আজও তা বহমান।
মন্দিরটির জায়গা দান করেছেন আবদুল হাকিম:
মুকুন্দবাগ গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা প্রয়াত আব্দুল হাকিম মণ্ডলের ইচ্ছা অনুসারে তার পুত্রেরা এখানে জমিটি দান করেছিলেন। দান করা সেই জমির ওপর গড়ে উঠেছে এই মন্দির। গঙ্গার পূর্ব পাড়ে তৈরি এই মন্দিরটি সম্প্রীতির এক অনন্য সুর তৈরি করেছে। মুসলিমদের তৈরি এই কিরীটেশ্বরী ভারতসেরা শ্রেষ্ঠ পর্যটন গ্রামের স্বীকৃতি মেলায় খুশির হাওয়া হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে।