জেব আখতার / রাঁচি
	
	
	এক সময় জামশেদপুরের আজাদ বস্তির নাম মানুষকে ভয় পাইয়ে দিত। ধানবাদের ওয়াসেইপুরের মতো, সেই সময় এটি অপরাধ ও নেতিবাচক কাজের জন্য কুখ্যাত ছিল। কিন্তু আজ এক ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি ও অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে আজাদ বস্তি এখন গৌরবের সঙ্গে পরিচিত। এই ব্যক্তিটি হলেন—মুখতার আলম খান।
	
	
	মুখতারকে একজন পরিবর্তনসাধক (চেঞ্জমেকার) হিসেবে গণ্য করা হয়, যার নিঃস্বার্থ কাজ তাঁর সম্প্রদায়ের ভাবমূর্তি ও মানসিকতা পরিবর্তন করেছে। আর এই অভিযানে তিনি কখনো একা ছিলেন না। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৈয়দ মতিনুল হক আনসারি, মুহাম্মদ মইনুদ্দিন আনসারি ও সায়েদ আসিফ আখতার তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপে পাশে থেকেছেন। তাঁরা একসঙ্গে জামশেদপুরের দরিদ্র, দুর্বল ও অভাবী মানুষদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
	 
	 
	বিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে মুখতার আলম
	 
	রোগীর জন্য রক্ত ও ওষুধের ব্যবস্থা করা, ক্ষুধার্ত মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করা, বা ছাত্রছাত্রীদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সাহায্য করা—এই সব ক্ষেত্রেই মুখতার আলম ও তাঁর দল সর্বদা সক্রিয় থাকে। তাঁদের কাজ মানবতা ও সহমর্মিতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। অর্থের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মুখতার বিনয়ের সঙ্গে বলেন, “এর কিছু অংশ আমাদের নিজেদের পকেট থেকে আসে, আর কিছু অংশ জনগণের অনুদান থেকে। রমজানের সময় আমরা দরিদ্র মানুষদের সাহায্যের জন্য যাকাতের অর্থ ব্যবহার করি।”
	
	
	২০১৯–২০ সালে, যখন কোভিড-১৯ লকডাউনে জীবন প্রায় থমকে গিয়েছিল, তখন অধিকাংশ মানুষ ঘরে বন্দি ছিল। কিন্তু মুখতার ও তাঁর দল মানুষের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা আজাদ বস্তি ও আশেপাশের এলাকায় খাদ্য, বস্ত্র ও ওষুধ বিতরণ শুরু করেন। তাঁরা গুরুতর রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করানোর ব্যবস্থা করেন, অক্সিজেন সিলিন্ডার সংগ্রহ করেন এবং জরুরি অবস্থায় রক্তদাতাদের সন্ধান করেন। অন্যদের বাঁচাতে তাঁরা নিজেদের জীবনও ঝুঁকির মুখে ফেলেছিলেন।
	
	
	যখন লকডাউন শেষ হয়ে জীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করে, তখন মুখতার স্পষ্টভাবে বলেন—“এই কাজ ভবিষ্যতেও বন্ধ হবে না।” এরপর তিনি লকডাউনের পর জামশেদপুরের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল এম.জি.এম. হাসপাতালে দরিদ্র রোগী ও তাঁদের পরিবারের জন্য খাদ্যসেবা শুরু করেন। এই উদ্যোগকে আরও সুষ্ঠুভাবে সংগঠিত করার জন্য তিনি হিউম্যান ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, জামশেদপুর (Human Welfare Trust, Jamshedpur) প্রতিষ্ঠা করেন।
	 
	মুখতার আলম ও তাঁর দলের খাদ্য বিতরণের একটি দৃশ্য 
	 
	তিনি বলেন, “বেশিরভাগ রোগী দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে আসে। তাঁদের চিকিৎসা ঠিকমতো হয়, কিন্তু তাঁরা পর্যাপ্ত খাদ্য বা আশ্রয় পান না। তাই আমরা সপ্তাহে দু’বার বিনামূল্যে খাদ্যের ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।” আজ প্রতি সপ্তাহে ৫০০-রও বেশি রোগী ও তাঁদের পরিচারক স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করেন — এবং এই সেবা এখনও অব্যাহত রয়েছে। এটি মুখতারের পরিচয়ের পাশাপাশি বহু মানুষের জীবনের আশ্রয় হয়ে উঠেছে।
	
	
	খাদ্যসেবার পর মুখতার শুরু করেন আরও একটি উদ্যোগ — বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ এবং রক্তদান কর্মসূচি আয়োজন। তাঁর নেতৃত্বে হাজার হাজার ইউনিট রক্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। কোনো প্রকার বৈষম্য ছাড়াই প্রতিটি সেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এবং সবার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে।
	
	
	মুখতার ও তাঁর সহযোগীরা পিছিয়ে পড়া আদিবাসী জনগোষ্ঠী “সাবার সম্প্রদায়”-এর পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্রতি মাসে একবার তাঁরা সাবার সম্প্রদায়ের ছেলে-মেয়েদের শহরে নিয়ে ঘুরতে যান এবং তাদের উপহার ও খাদ্যসামগ্রী দেন। যখন টুনা সাবার ও তাঁর স্ত্রী চুমি সাবারকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল, তখন হিউম্যান ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট তাঁদের জন্য পুষ্টিকর পরিপূরক, ওষুধ এবং ফলমূল সরবরাহ করেছিল। এর ফলে তাঁরা সম্পূর্ণ চিকিৎসা সহায়তা পেতে সক্ষম হন।
	
	
	প্রতিটি বড়দিনে মুখতারের দল সাবার গ্রামে গিয়ে গরম কাপড়, জুতো, স্টেশনারি ও খাদ্য বিতরণ করে। তাঁদের সেবা এখন শহরের বাইরে গ্রামীণ ও আদিবাসী অঞ্চলেও বিস্তৃত হয়েছে।
	মুখতার জানতেন যে সমাজে প্রকৃত পরিবর্তন আসে শিক্ষার মাধ্যমে। স্থানীয় শিশুদের অনুপ্রাণিত করতে তিনি NEET, Civil Services, CA, এবং Judiciary পরীক্ষায় সফল প্রার্থীদের আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই এর ফলাফল দেখা যায়। আজাদ বস্তির তরুণ-তরুণীরা বড় স্বপ্ন দেখতে শুরু করে এবং সাফল্যের জন্য কঠোর পরিশ্রমে নেমে পড়ে।
	 
	মুখতার আলমের দেওয়া নতুন স্কুল ব্যাগ হাতে শিশুরা
	
	
	সবচেয়ে গর্বের মুহূর্তটি আসে ২০২৪ সালে, যখন এক ফল বিক্রেতার কন্যা কাহকাশান পারভীন NEET-UG পরীক্ষায় ৭২০-এর মধ্যে ৭২০ পেয়ে ভারতের অন্যতম শীর্ষ স্কোরার হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তাঁর এই সাফল্য শুধু পরিবারের নয়, পুরো জামশেদপুর সমাজের জন্যই আনন্দ ও গৌরব বয়ে আনে। ২০২৫ সালে ঈদে মিলাদুন্নবীর দিনে হিউম্যান ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট আজাদ ম্যারেজ হলে এক মেগা রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে। সংগঠনটি একদিনে রেকর্ডসংখ্যক ৩০৩ ইউনিট রক্ত সংগ্রহ করে। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ঝাড়খণ্ডের অতিরিক্ত সচিব ট্রাস্টের এই উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন,“হিউম্যান ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট সবসময় বৈষম্যহীনভাবে মানবতার সেবা করে আসছে। যখনই কারও রক্তের প্রয়োজন হয়, তখনই তারা সবার আগে সাড়া দেয়।”
	
	
	মুখতারের উদ্যোগের বিস্তার অব্যাহত রয়েছে। তাঁর দল জনসাধারণের পানীয় জলের স্টেশন স্থাপন করেছে, শীতকালে কম্বল বিতরণ করে, দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহায়তা করে এবং মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার জন্য অর্থসাহায্য প্রদান করে। এর পাশাপাশি তাঁরা শিশুদের খেলাধুলার কিট দেয়, সাফল্য অর্জনকারী মানুষদের সম্মাননা প্রদান করে, রিকশাচালকদের নিজস্ব বাহন কিনতে সহায়তা করে এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা শুরু করতে সহায়তা করে। এমনকি বিপদে পড়া মানুষদের জন্যও ট্রাস্টটি একটি হেল্প ডেস্ক পরিচালনা করে।
	 
	স্থানীয় মানুষের সঙ্গে মুখতার আলম
	
	
	২০২৩ সালে তাঁরা সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি লাভ করেন। জেলা প্রশাসন গণপ্রজাতন্ত্রী দিবসে হিউম্যান ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টকে অসাধারণ সমাজসেবার জন্য সম্মানিত করে। আজ জামশেদপুরে মুখতার আলম খানের হিউম্যান ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট এক আশার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। সামাজিক কল্যাণের প্রতিটি উদ্যোগ তাদের নামের ব্যানারে চলছে। একসময় অপরাধ ও ভয়ের জন্য কুখ্যাত আজাদ বস্তি আজ পরিবর্তন, মমতা ও ঐক্যের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত।
	
	
	এই রূপান্তর একদিনে সম্ভব হয়নি। এর জন্য লেগেছে বছরের পর বছর পরিশ্রম, সাহস ও নিঃস্বার্থ উদ্দেশ্য। আজাদ বস্তির সরু গলি থেকে জামশেদপুরের মানবতাবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রে মুখতার আলমের যাত্রা প্রমাণ করে যে যখন সেবা হৃদয় থেকে আসে, তখন সবচেয়ে অন্ধকার জায়গাও আলোয় ভরে ওঠে।