এক শিক্ষক, এক স্বপ্ন: ফুটবলের মাধ্যমে শিশুদের নতুন দিগন্তে আনোয়ারুল হক

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 7 h ago
আনোয়ারুল হক
আনোয়ারুল হক
 
জেব আখতার

দারিদ্র্য আর বঞ্চনা প্রায়ই শিশুদের স্বপ্নকে ধ্বংস করে দেয়, স্বপ্ন দেখার আগেই। ঝাড়খণ্ডের গ্রামীণ অঞ্চলে এমন দৃশ্য খুবই পরিচিত। তবু এই একই অঞ্চল থেকেই আজ উঠে আসছে আশার গল্প।
 
তেমনই এক গল্প চাঁদড়ি গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ারুল হকের। রাঁচির কাঁকে ব্লকের এই যুবক এক অনন্য উদ্যোগ শুরু করেছেন। দিনে তিনি শিশুদের ফুটবল শেখান, আর রাতে পড়াশোনা করান। মাত্র তিন বছরের মধ্যেই তাঁর প্রচেষ্টা বদলে দিয়েছে বহু শিশুর জীবন, যাদের কাছে শিক্ষা ও খেলাধুলা একসময় ছিল অচিন স্বপ্ন।
 
আনোয়ারুল হক রাঁচি প্রেস ক্লাবে
 
রাঁচির এক আবাসিক কন্যা বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক আনোয়ারুল নিজের দায়িত্বের বাইরেও সমাজের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন। ২০২১ সালে তিনি লক্ষ্য করেন, গ্রামের বেশিরভাগ শিশু, দৈনিক মজুরির শ্রমিক পরিবারের সন্তান, স্কুলে যায় না বা ভুল পথে চলে যাচ্ছে। তিনি বুঝলেন, শিক্ষা ও খেলাধুলার মাধ্যমে তাদের ফিরিয়ে আনা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ছিল না কোনো মাঠ, না ছিল কোনো উপকরণ।
 
তবু তিনি হাল ছাড়েননি। গ্রামের চাষের জমি সমান করে বানিয়েছেন অস্থায়ী ফুটবল মাঠ। চাষের মরসুমে অন্য জায়গায় অনুশীলনের ব্যবস্থা করেছেন। নানা বাধা সত্ত্বেও তাঁর অধ্যবসায় আর শিশুদের উৎসাহ ধীরে ধীরে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।
 
আনোয়ারুল হক তাঁর একাডেমির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে
 
শিশুদের মাঠে আনতে অভিভাবকদের রাজি করানো ছিল আরেক বড় চ্যালেঞ্জ। দরিদ্র পরিবারের অনেকেই বুঝতে পারছিলেন না ফুটবল শিখে তাদের সন্তানদের কী লাভ হবে। কেউ কেউ গুজবও ছড়িয়েছিলেন যে আনোয়ারুল ব্যক্তিগত স্বার্থে এটি করছেন। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। নিজে নিজে প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে বোঝান, দিনে খেলাধুলা, রাতে পড়াশোনা হবে। ধীরে ধীরে বিশ্বাস তৈরি হয়, আর শিশুরা আসতে শুরু করে।
 
শুরুটা হয়েছিল মাত্র চারজন মেয়েকে নিয়ে। এখন তা এক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। তাঁর “স্টার ওয়ারিয়র্স ক্লাব” এখন পর্যন্ত কাঁকে ও অরমাঞ্জি এলাকার প্রায় ১৫০ জন শিশুকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। বর্তমানে ৬০–৬৫ জন সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছে এবং ১৪ জন মেয়ে জাতীয় পর্যায়ে খেলেছে। সবচেয়ে বড় সাফল্য, দিব্যানি লিন্ডা, যিনি ভারতের অনূর্ধ্ব-১৭ মহিলা ফুটবল দলে জায়গা করে এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলছেন।
 
বিজয়ীদের সঙ্গে আনোয়ারুল হকের একটি ছবি
 
দিব্যানি লিন্ডার-এর গল্প
 
দিব্যানির জীবনই আনোয়ারুলের কাজের প্রকৃত প্রতিফলন। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জন্ম; বাবা মৃত, মা দিনমজুর, ভাই ভাঙা পায়ে শয্যাশায়ী। তবু ফুটবলেই খুঁজে পেয়েছেন বাঁচার শক্তি। আনোয়ারুলের তত্ত্বাবধানে তিনি জাতীয় দলে জায়গা পান এবং এখন দেশের হয়ে খেলছেন। দিব্যানি বলেন, “ফুটবল খেলে যে টাকা রোজগার করব, তা দিয়ে আমি আমার ভাইয়ের চিকিৎসা করাব।” 
 
আনোয়ারুলের কাছে এটাই প্রকৃত পুরস্কার। তিনি বলেন, “যখন দিব্যানির মতো শিশুরা সফল হয়, তখন মনে হয় আমাদের পরিশ্রম সার্থক। তাদের চোখের আশাই আমাদের আসল অর্জন।”
 
মেয়েদের মাঠে নামানো ছিল আরও কঠিন। প্রথম দিকে শর্টস পরে মাঠে নামায় গ্রামবাসীরা আপত্তি তোলে, অভিভাবকেরাও দ্বিধায় ছিলেন। কিন্তু আনোয়ারুল ধৈর্য ধরে সকলকে বোঝান। আজ মেয়েরা ছেলেদের পাশে সমানভাবে দাঁড়াচ্ছে।
 
কোচ আনোয়ারুল হক দিব্যানীর সঙ্গে, (বামে) যখন সে একজন উদীয়মান ক্রীড়াবিদ এবং (ডানে) যখন সে একজন জাতীয় খেলোয়াড়
 
তাঁর উদ্যোগ এখন স্থানীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সমাজকর্মী জগদীশ সিং জাগ্গু সবসময় পাশে আছেন। স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারাও প্রায়ই এসে শিশুদের উৎসাহ দেন। আন্তর্জাতিক হকি খেলোয়াড় নিকি প্রধানের উৎসাহও তাদের অনুপ্রাণিত করেছে। গত আগস্টে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে বিদেশি অতিথিরা ক্লাবে এসে এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং সহযোগিতার অঙ্গীকার করেছেন।
 
সব অগ্রগতির পরও সমস্যা শেষ হয়নি। প্রধান সমস্যা, স্থায়ী ফুটবল মাঠের অভাব। আনোয়ারুল বলেন, “শিশুরা যখন রাজ্য বা জাতীয় স্তরে জয়ী হয়ে ফেরে, তখন সবাই প্রশংসা করে, প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর সব ভুলে যায়।”
 
আনোয়ারুলের ভাবনা শুধুই ফুটবল নয়। যেসব শিশু দিনে ঘামে ভিজে মাঠে দৌড়ায়, তারা রাতে তাঁর কাছেই পড়াশোনা করে। তাঁর বিশ্বাস, শিক্ষা ও খেলাধুলার মেলবন্ধনই পারে মজবুত ভবিষ্যৎ গড়তে। দরিদ্র পরিবার থেকে আসা এই শিশুদের জীবনের কষ্টই এখন তাদের শক্তিতে পরিণত হয়েছে। অল্প সময়েই তাঁর ক্লাব রাজ্য ও জাতীয় স্তরে পরিচিতি অর্জন করেছে।
 
আনোয়ারুল হক তাঁর একাডেমির একটি এক ছাত্র ও তার অভিভাবকদের সঙ্গে
 
আনোয়ারুলের কাজ ধীরে ধীরে সমাজকেও বদলে দিচ্ছে। শিশুরা নেশা ও খারাপ প্রভাব থেকে দূরে সরে এসে খেলাধুলা ও শিক্ষার মধ্যে অর্থপূর্ণ জীবন খুঁজে পাচ্ছে। পরিবারগুলোও পরিবর্তনটা দেখতে পাচ্ছে। নেতারা আসেন-যান, কিন্তু আনোয়ারুলের আসল আনন্দ তখনই, যখন তাঁর ছেলেমেয়েরা মাঠে জয় পায়।
 
যে গ্রামগুলোতে বঞ্চনা মানুষের স্বপ্ন কেড়ে নেয়, সেই চাঁদড়ির “স্টার ওয়ারিয়র্স ক্লাব” আজ দেখিয়ে দিচ্ছে, ইচ্ছাশক্তি থাকলে কিছুই অসম্ভব নয়। আনোয়ারুল হক প্রমাণ করেছেন, এক ব্যক্তির ছোট উদ্যোগও বড় সামাজিক পরিবর্তন আনতে পারে। তাঁর কাছে ফুটবল শুধু খেলা নয়, এটি সমাজ পরিবর্তনের এক শক্তিশালী হাতিয়ার। তাঁর সাহস ও অদম্য প্রতিশ্রুতি সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।