জেব আখতার / রাঁচি
২০১০ সালে, রাঁচির ইসলাম নগর ও বাবা খাতাল অঞ্চলে উচ্ছেদ অভিযানের ফলে শত শত পরিবার এক মুহূর্তে গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল শিশুরা, অনেকে পরীক্ষায় বসতে পারেনি, আবার কেউ কেউ স্থায়ীভাবে স্কুল ছেড়ে দেয়।
এই কঠিন পরিস্থিতিতেই এক আশার আলো দেখা দেয়। তানভীর আহমদ ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু সিদ্ধান্ত নেন, এই ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের শিক্ষার পথে ফেরাতে তাঁরা এগিয়ে আসবেন। তাঁর মনে হলো, যদি পরিস্থিতি তাদের কাছ থেকে স্কুল কেড়ে নেয়, তাহলে কেন বন্ধুত্বের হাত ধরে আবার শিক্ষা ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না? এই ভাবনা থেকেই শুরু হয় এক অনন্য যাত্রা, বন্ধুত্ব থেকে শিক্ষার পথে।
তানভীর আহমদ
তানভীর আহমদ বলেন, “আমাদের লক্ষ্য হল রাঁচি ও ঝাড়খণ্ডের সেই বঞ্চিত শিশুদের কাছে পৌঁছানো, যারা মূলধারার শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, শিক্ষা এমন এক চাবিকাঠি যা তাদের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে।” রাঁচির নাম শুনলে সাধারণত মনে পড়ে সবুজ পাহাড়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর দ্রুত বিকাশমান শহরের ছবি। কিন্তু এই উজ্জ্বল চিত্রের আড়ালে লুকিয়ে আছে আরেক বাস্তবতা, শহরের বৃহৎ অংশের মানুষ বস্তি ও অস্থায়ী আশ্রয়ে বাস করে।
তবে এই উদ্যোগে তানভীর একা ছিলেন না। তাঁর সঙ্গে যোগ দেন একই মানসিকতার কিছু বন্ধু, মোহাম্মদ খালিল, কামার সিদ্দিকি, শামীম আখতার, মোহাম্মদ জাভেদ ও মাজহার হুসেন। তাঁরা বস্তি অঞ্চলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবারগুলির সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন, শিশুদের আবার স্কুলে ফিরিয়ে আনতে উৎসাহ দেন। তাঁরা অভিভাবকদের বোঝান যে শিক্ষাই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে তাঁদের পাশে থাকবেন।
একটি দরিদ্র মহিলাকে সাহায্য প্রদান করছেন তানভীর আহমদ
কিন্তু পরিবারগুলিকে রাজি করানোই ছিল না একমাত্র বাধা। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল অর্থ, স্কুল ফি, বই, ইউনিফর্ম ও অন্যান্য খরচ। এই সমস্যা কাটাতে তানভীর ও তাঁর বন্ধুরা উদ্ভাবনী পথ খুঁজে পান; রমজান মাসে সংগৃহীত যাকাতের (ধর্মীয় দান) ১০ থেকে ২০ শতাংশ অর্থ তারা শিক্ষার কাজে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নেন। এই উদ্যোগের মাধ্যমে প্রথমে তাঁরা ৮৫ জন শিশুর দায়িত্ব নেন, তাদের স্কুল ফি, বইপত্র ও মৌলিক চাহিদা মেটানো হয়। কিন্তু চ্যালেঞ্জ এখানেই শেষ হয়নি। অনেক ছাত্র পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়তে থাকে, আবার স্কুল ছেড়ে দেওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
এবার তাঁরা শুরু করেন “হোম কোচিং টিউশন”, বস্তির মধ্যেই বিনামূল্যের পাঠকেন্দ্র। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত আলাদা ব্যাচ তৈরি করা হয়। এই “হোমওয়ার্ক গাইডেন্স সেন্টার”-গুলি শিশুদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনে এবং শিক্ষার ধারায় ফিরিয়ে দেয়। ক্রমে তাঁরা মেধাবী ছাত্রদের জন্য একটি বৃত্তি প্রকল্পও শুরু করেন, যাতে ভালো ফলাফল করা শিক্ষার্থীরা পুরস্কৃত হয় এবং অন্যদের অনুপ্রেরণা পায়। শুধু আর্থিক সাহায্যই নয়, তাঁরা হয়ে ওঠেন প্রেরণার উৎস।
একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার মুহূর্তে তানভীর আহমদ
আজ এই উদ্যোগটি “ফ্রেন্ডস অফ উইকার সোসাইটি” নামে পরিচিত। গত ১২–১৩ বছরে তানভীর আহমদ ও তাঁর দল ৬,০০০-এরও বেশি শিশুর শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন, স্কুল থেকে শুরু করে চিকিৎসা ও প্রকৌশল পড়ুয়া পর্যন্ত।
তাঁদের কাজ কেবল শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। শীতকালে তাঁরা শিশুদের গরম কাপড় ও সোয়েটার বিতরণ করেন, রমজান বা দুর্যোগকালে দরিদ্র পরিবারগুলিকে খাদ্য ও রেশন সহায়তা দেন। বিনামূল্যে চিকিৎসা শিবিরও আয়োজন করেন এবং “ডোর-টু-ডোর অন-স্পট অ্যাডমিশন প্রোগ্রাম”-এর মাধ্যমে নিশ্চিত করেন যাতে কোনো শিশু ভর্তি থেকে বঞ্চিত না হয়। সংখ্যালঘু ছাত্রদের জন্য সরকারি বৃত্তি প্রকল্প সম্পর্কেও তাঁরা সচেতনতা বাড়ান।
তানভীর আহমদ এবং তার সহকর্মীরা সম্ভাব্য সুবিধাভোগীদের নিবন্ধন করার একটি দৃশ্য
ফ্রেন্ডস অফ উইকার সোসাইটির প্রকৃত সাফল্য লুকিয়ে আছে সেইসব গল্পে, যেগুলি তাঁদের সহায়তা ছাড়া হয়তো থেমে যেত। যেমন, রাঁচির হিন্দপিরির মুজাহিদ, যার স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়া। ২০১৩ সালে সে আইআইটি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল, কিন্তু অর্থের অভাবে ভর্তি হতে পারেনি। পরের বছর আবার চেষ্টা করে সফল হয়, এবং তখন তানভীর ও তাঁর দল ভর্তি ফি বহন করে। আজ মুজাহিদ একজন পেশাদার ইঞ্জিনিয়ার।
ঠিক তেমনই রামগড়ের মোহাম্মদ আরিফ ও লাতেহারের নাফিস আখতার দুজনেই এখন টাটা মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস করছেন, তাঁদের পড়াশোনার খরচ বহন করেছে এই সংগঠন। জামশেদপুরের জাভেদ আনসারির আল-কবির ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়া চালিয়ে যাওয়াও সম্ভব হয়েছে তাঁদের সহায়তায়। এই সমাজসেবী উদ্যোগের ফলে স্কুলছুটের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। বহু শিশু, যারা একসময় দারিদ্র্যের কারণে শিক্ষার পথ থেকে সরে যাচ্ছিল, আজ দেশের নামী ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করছে।
একটি পরিবারের সঙ্গে তানভীর আহমদ ও তার সঙ্গীরা
সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হল, এই উদ্যোগ কোনো সরকারি অনুদান ছাড়াই চলছে। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তানভীর আহমদ ও তাঁর দল শুধুমাত্র বিশ্বাস, সহমর্মিতা ও সমাজের সহযোগিতার উপর নির্ভর করে এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের কাছে শিক্ষা কেবল বইয়ের বিষয় নয়, এটি এক বন্ধুত্ব ও বিশ্বাসের মিশন।
আজ রাঁচি ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় প্রায় দুই হাজার শিশু সরাসরি এই দলের সাহায্য পাচ্ছে। তাঁদের গল্প প্রমাণ করে যে বন্ধুত্ব, সততা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা একত্রিত হলে শিক্ষা শুধু আলো নয়, স্বপ্নকেও ডানা দেয়। তানভীর আহমদ ও তাঁর দল প্রমাণ করেছেন, শিক্ষাই আশা ও মানবতার সবচেয়ে উজ্জ্বল আলোকরশ্মি।