পিছিয়ে পড়া সমাজের মেয়েদের স্বাবলম্বী করার পণ নিয়ে এগিয়ে চলেছেন 'লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থা'র প্রতিষ্ঠাতা হাফিজুর রহমান

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 7 h ago
 'লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থা'র প্রতিষ্ঠাতা হাফিজুর রহমান
'লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থা'র প্রতিষ্ঠাতা হাফিজুর রহমান
 
কুতুব আহমেদ / নদিয়া

হাফিজুর সাহেব মানে হাফিজুর রহমান। নদিয়ার চাপড়া থানার অন্তর্গত লক্ষ্মীগাছা অঞ্চলের বাসিন্দা এবং 'লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থা'র সর্বময় কর্তা। একটু বিস্তারিত বলা যাক। কলকাতা থেকে লক্ষ্মীগাছার দূরত্ব মোটামুটি ১৪০ কিলোমিটার। মুসলিম অধ্যুষিত একটি জনপদ।  হাফিজুর সাহেবের তাঁর আপোসহীন ব্যক্তিত্ব এবং হার না মানা মনোভাব দিয়েই তিনি জয় করেছিলেন মানুষের মন।  বাম আমলের তৎকালীন ক্রীড়া,পরিবহনমন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী অত্যন্ত স্নেহ করতেন আটপ্রৌঢ়ে এই মানুষটিকে। আটপ্রৌঢ়ে এই কারণেই যে, আজীবন অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করেছেন তিনি। যে ধারা বজায় রয়েছে এখনও। আজও মাটি ছুঁয়ে থেকে মাটির মানুষদের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করেন হাফিজুর রহমান।
 
তো যে কথা বলছিলাম। হাফিজুর রহমানের ডাকে লক্ষ্মীগাছার উদ্দেশ্যে রওনা হবার জন্য একটু সকাল সকালই বেরিয়েছিলাম। তবু তাঁর বাড়ি পৌঁছাতে ১২টার বেশিই বেজে গেল। লক্ষ্মীগাছা বাসস্ট্যান্ডে নাতির হাত ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন সত্তর ছুঁই ছুঁই মানুষটি। বাস থেকে নামতেই সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে গেলেন বাড়িতে। যেতে যেতে রাস্তার দু-পাশে বেশ কিছু ছিটে বেড়া দেওয়া ঘর এবং পাকা বাড়ির সহাবস্থান চোখে পড়ল। লক্ষ্মীগাছা অঞ্চলটি মুসলিম অধ্যুষিত হলেও তাঁদের সঙ্গেই কয়েকটি হিন্দু পরিবারও মিলেমিশে থাকে। সম্প্রীতির এমন নজির গ্রাম বাংলায় এখনও বহাল তবিয়তে বিরাজ করছে। এই দুঃসময়ে যা আমাদের কাছে অত্যন্ত গর্বের একটি ব্যাপার।
 
'লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থা'র নারী প্রশিক্ষনার্থীদের সঙ্গে হাফিজুর রহমান 
 
এই লেখার শুরুর দিকে হাফিজুর রহমানকে 'লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থা'র সর্বময় কর্তা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ এই সমাজসেবী প্রতিষ্ঠানটির সম্পাদক তিনি। কিন্তু একজন সম্পাদক হয়ে ওঠা কি সত্যি সত্যিই খুব সহজ ব্যাপার! বোধহয় না। কারণ, আমরা বাইরে থেকে কোনও সংস্থার পরিচালককে যেভাবে দেখি, তাঁর পরিচালক হয়ে ওঠার পিছনের ইতিহাস যদি জানি, তবে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসতে বাধ্য হবে। হাফিজুর রহমানের জীবনটাও এমন একটা খাতে বয়ে গেছে, যে খাতের দিকে না তাকালে তাঁকে চেনা যাবে না, উপলব্ধি করা সম্ভব হবে না তাঁর কর্মকাণ্ডকে। নানান বাঁক, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সমিতিকে দাঁড় করিয়েছেন তিনি। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত না খেয়ে, কখনও শিয়ালদা স্টেশনে রাত কাটিয়ে, একমুঠো মুড়ি খেয়ে মানুষের দরবারে দরবারে ঘুরেছেন নীতির সঙ্গে কোনওরকম আপোস না-করা মানুষটি। কেন গিয়েছেন মানুষের দরবারে। কারণ, তাঁর সমাজের মুসলিম মেয়েদের স্বাবলম্বী করার ভূত তখন চেপেছে তাঁর মনে। সেই ভূত এতটাই তাড়া করে ফিরেছে তাঁকে, যে, নিজের চাষের জমি বিক্রি করে মেয়েদের জন্য সেলাই মেশিন কিনে ফেলেছেন সমাজসেবার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা হাফিজুর। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর এই যে পাগলামি, সত্যি অর্থে কোনও পাগল মানুষ ছাড়া এই কাজ হবার নয়।
 
বাংলার ভূমিপুত্র, বিশিষ্ট বাঙালি শিল্পপতি, দানবীর মোস্তাক হোসেনের সঙ্গে দেখা করার জন্য বছরের পর বছর তাঁর পার্ক স্ট্রিট অফিসে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছেন হাফিজুর রহমান। অবশেষে প্রায় আট বছর পর দেখা পেয়েছেন মোস্তাক সাহেবের। তাঁর কাঙ্ক্ষিত আশা পূরণ হয়েছে। মোস্তাক হোসেন প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা দিয়ে লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সমিতির কর্মক্ষেত্রে ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন। ভবিষ্যতে দোতলা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। এছাড়াও সেলাই মেশিন কেনা সহ আরও বেশ কয়েকটি খাতে টাকা দিয়েছেন পতাকা শিল্পগোষ্ঠীর প্রাণপুরুষ জনাব মোস্তাক হোসেন সাহেব।
 
১৯৯৫ সালে সুরাবউদ্দিন বিশ্বাস সহ আরও ৬ জন ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে নিয়ে 'লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থা' প্রতিষ্ঠা করেন হাফিজুর রহমান। লক্ষ্মীগাছা অঞ্চলের সংখ্যালঘু মুসলিম মেয়েদের দুর্দশা দেখে চোখে জল ধরে রাখতে পারেননি তিনি। বিবাহ-বিচ্ছিন্না, বিধবা,স্বামী পরিত্যক্ত অসংখ্য মেয়ের দহনজ্বালা স্থির থাকতে দেয়নি তাঁকে। ফলে সাত পাঁচ না ভেবেই তাদের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করলেন হাফিজুর। প্রথমে চাপড়া অঞ্চলে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে মেয়েদের সেলাইয়ের কাজে ট্রেনিং দেওয়া হয়। কিন্তু ঘরভাড়া, প্রশিক্ষকের পারিশ্রমিক কোথা থেকে আসবে সেসব নিয়ে কোনও ভাবনা ছিল না উদ্যোক্তাদের মনে। বাধ্য হয়ে নিজের জমির ধান বিক্রির টাকা 'হাতিয়ে' ঘরের ভাড়া মেটালেন হাফিজুর। এমনকি মেয়েদের হাতেও কিছু কিছু টাকা তুলে দিলেন হাতখরচা বাবদ। অনেক পরে মেয়েদের তৈরি সায়া বিক্রির টাকা থেকে সেই 'হাতিয়ে' নেওয়া বা 'চুরি'-র টাকা যথাস্থানে রেখে দেন তিনি। এমনই এক নির্মম যাপনকে বুকে লালন করে এগিয়ে চলেছেন হাফিজুর রহমান।
 
'লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থা'য় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারীদের একটি ছবি 
 
১৯৯৫-২০২০ লকডাউনের আগে পর্যন্ত মোট ২৫ বছর ধরে প্রায় ২০০০ মেয়েকে সেলাইয়ের ট্রেনিং দিয়েছে হাফিজুর রহমান প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থা। তাঁরা এখন প্রায় সকলেই স্বাবলম্বী। সংসারের হাল ধরে নিজেদের কঠোর পরিশ্রম আর যোগ্যতার প্রমাণ রেখে চলেছেন প্রতিনিয়ত। আর এসবের পিছনে যে মানুষটির অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি নীরবে-নিভৃতে অবলোকন করে চলেছেন সবকিছু। তবে ২০০০ মেয়েকে শুধু ট্রেনিং দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থা। ৬০ জন অতি দুঃস্থ মেয়েকে সেলাই মেশিন দেওয়া হয়েছে যাতে তারা কাজ করে স্বাবলম্বী হতে পারে। এখানেও মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সম্পাদক হাফিজুর রহমান। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মেয়েরা যেমন তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হয়েছে, তেমনই উভয় সম্প্রদায়ের দুঃস্থ-অসহায় মেয়েদেরই সেলাই মেশিন দান করেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পথিকৃত হাফিজুর রহমানের সংস্থা।
 
মোস্তাক হোসেনের টাকায় বেশ কয়েক কাঠা জায়গার ওপর নির্মিত হয়েছে লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি। চারপাশ নানারকম গাছগাছালিতে ভরা। পিছন দিকে দুটি পুকুর। ছায়াশীতল এক মনোরম পরিবেশ। যাঁরা শান্তিনিকেতন গিয়েছেন তাঁরা এখানে আসলে তার ছোঁয়া পাবেন কিছুটা, এ কথা হলফ করে বলাই যায়। লকডাউনের সময় থেকে দীর্ঘ কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর ২০২৪ সাল থেকে আবার নতুন করে পথচলা শুরু করেছে লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থা। 
 
আশপাশের অঞ্চলের বহু আগ্রহী মেয়ের আবদার ফেলতে পারেননি হাফিজুর রহমান। নব পর্যায়ে তাই আবার পুরোদমে কাজ শুরু করেছে লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থা। এই মুহূর্তে সংস্থার ঘরে প্রায় ৪০টি সেলাই মেশিন আছে। নতুন করে কাজ শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে প্রশিক্ষণ নিতে চলে এসেছেন আজমা খাতুন, নাসরিনা খাতুন বিশ্বাস, সেরেনা বিবি, শম্পা মন্ডল, পারমিতা কর্মকার, মাফুজা খাতুন, রেশমা খাতুন, সাহেরা সুলতানা বিশ্বাস, তানিয়া খাতুন, ইসমাতারা খাতুন, বর্ষা খাতুন, হাদিসা খাতুনরা। এদের অনেকেই স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করছেন। কেউ বা সংসারের কাজ সামলে স্বামী-সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য স্বাবলম্বী হতে চাইছেন। আবার কেউ কেউ অসুস্থ বাবার ওপর যাতে আর্থিক চাপ না পড়ে, তার জন্য নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই জোগাড় করার আশায় কাজ শিখছেন। কেউই আর্থিক সংগতি সম্পন্ন নয়। তবে প্রায় সকলেই কমবেশি লেখাপড়া জানেন। দারিদ্রের তীব্র কষাঘাতকে উপলব্ধি করেন তাঁরা। আর যে মানুষটি তাঁদের স্বাবলম্বী হবার স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সেই হাফিজুর রহমানকে আনত প্রণতি জানান মনে মনে।
 
লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থার একমাত্র প্রশিক্ষক অচিন্ত্য খান। যিনি বিশুবাবু নামেই সমধিক পরিচিত। ৩০ বছরের অভিজ্ঞ এই প্রশিক্ষক সেন্ট স্টিফেন্স ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার থেকে ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তাঁর দক্ষ প্রশিক্ষণে সেলাইয়ের কাজে দ্রুত হাত পাকাচ্ছেন সংস্থার শিক্ষার্থীরা।
 
হাফিজুর রহমান এই পর্যন্ত করেই হয়তো ক্ষান্ত দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তো আর বসে থাকার মানুষ নন। ফলে আরও অসংখ্য ভাবনাকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলেছেন কাজপাগল এই মানুষটি। তাঁরই উদ্যোগে প্রতি ইংরাজি মাসের শেষ রোববার তাঁদের সংস্থার সামনের ঘরে ডাক্তার বসানোর ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, চক্ষু পরীক্ষা ইত্যাদির পাশাপাশি রোগীদের বিনামূল্যে ওষুধও দেওয়া হয় সংস্থার পক্ষ থেকে। এছাড়াও আশপাশের অঞ্চলের কাউকে যেন পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে বাইরের রাজ্যে কাজে যেতে না হয়, বিকল্প শিল্পের ব্যবস্থা করে তাদের যাতে কাজ দেওয়া যায়, সেই পরিকল্পনাও চালাচ্ছেন লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থার সম্পাদক হাফিজুর রহমান এবং তাঁর সঙ্গীসাথীরা।
 
সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মহিলা প্রশিক্ষণার্থীদের সাথে একজন প্রশিক্ষক
 
প্রশাসনের সহযোগিতা পেলে এই মহৎ উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তৎপর হয়ে উঠবেন তাঁরা।পাশাপাশি তাঁদের লক্ষ্য ২০২৭ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যেই স্বাবলম্বী হতে চাওয়া মেয়েদের নিয়ে সাফল্যের শিখর ছুঁয়ে ফেলা। তাঁদের তৈরি সায়া-ব্লাউজ-হিজাব-বোরখা বা অন্যান্য সামগ্রী বাজার ধরে ফেলবে বলেই হাফিজুর সাহেবদের বিশ্বাস।
 
এই যে বহুমুখি ভাবনা, এই যে নিঃস্বার্থ অথচ কঠোর পরিশ্রম, এই যে অপরের জন্য নিজেকে সমর্পণ করা, এসব হাফিজুর রহমানের পরিবার কতটা মেনে নিতে পেরেছে এই প্রশ্ন থাকবেই। এর উত্তরও সহজ। কোনও পরিবারই চায় না তাঁদের ঘরের মানুষ নিজের জমি-জায়গা বিক্রি করে সমাজসেবার কাজে লাগাক। হাফিজুরের পরিবারও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। তবে তাঁদের উদারতা অন্য জায়গায়। তাঁরা কখনও হাফিজুরের কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াননি। বহু বিষয়ে পরিবার থেকে আপত্তি এসেছে, কিন্তু বাধা আসেনি। অথচ যে পার্টিকে তিনি প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন সেই পার্টিতে তাঁর বিরোধীরা তাঁকে বাধ্য করেছে পদ ছাড়তে, অপমান করেছে পদে পদে।
 
কিন্তু মানুষের ভালোবাসা যার সঙ্গে আছে তাকে আটকাবে কে। তাই নির্দ্বিধায়, নিঃসঙ্কোচে সিপিএম দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে এসেছেন হাফিজুর, মনোনিবেশ করেছেন সমাজসেবায়, গড়ে তুলেছেন লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থা, যা তাঁকে যেমন গর্বিত করেছে, উল্টোদিকে ইর্যান্বিত করেছে তাঁর বিরোধীদের। কিন্তু সবকিছু ঝেড়ে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে গেছেন একা কুম্ভ হাফিজুর রহমান।
 
লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থা গড়ে ওঠার যে ইতিহাস, সেই ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় লেগে আছে হাফিজুর রহমানের রক্ত ঘাম এবং কঠোর পরিশ্রমের ছোঁয়া। যখন দিনের পর দিন না খেয়ে, কখনও শুধু জল পান করে সময় অতিবাহিত করেছেন, তখন সান্ত্বনা খুঁজেছেন মহানবী রসুল সা.-এর জীবন থেকে। মহানবীর আদর্শ তাঁকে ক্ষুধার যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছে। ভুলিয়ে দিয়েছে জীবনের সব রকমের শোক আর হতাশাকে।
 
পলাশীর বিশিষ্ট দাতা বসির সাহেব, বিশ্বকোষ পরিষদের পার্থ সেনগুপ্ত, মীরাতুন নাহার, চতুরঙ্গের আবদুর রাউফ সহ অসংখ্য বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্য পেয়েছেন হাফিজুর রহমান।  এমন একজন মানুষ ইচ্ছা করলেই বহু কিছু অর্জন করে নিজের জীবনটাকে কাটিয়ে দিতে পারতেন আরাম আয়শের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু তিনি তা করেননি। লক্ষ্মীগাছা, বৃত্তিজদা,তালুকহুদা,গোখুরাপোতা সহ পাশ্ববর্তী আরও অনেক অঞ্চলের দুঃখীনি মেয়েদের দুর্দশা তাঁকে রাতের পর রাত শান্তিতে ঘুমাতে দেয়নি।
 
লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থাকে দাঁড় করানোর জন্য যে অর্থের প্রয়োজন তা জোগাড় করার জন্য অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন  মাস্টার ডিগ্রি সম্পন্ন করা হাফিজুর রহমান। শিয়ালদহে নেমে পায়ে হেঁটে মানিকতলা হয়ে সেখান থেকে আবার হেঁটে ধর্মতলায় গিয়েছেন। ধর্মতলা থেকে আবার হেঁটেই ফিরেছেন রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড, সেখান থেকে শিয়ালদা। এইভাবে শরীরের ওপর অত্যাচার করে নিজের জীবনের অনেকটা সময় বিলিয়ে দিয়েছেন তিনি,শুধুমাত্র মেয়েদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যেই।
 
লক্ষ্মী গাছা জনকল্যাণ সংস্থায় হাফিজুর রহমানকে সম্মান জানানো একটি মুহূর্ত
 
হাওড়ার বাঁকড়ার কাশেম   সাহেব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থাকে ৫ হাজার টাকা দেবেন। কিন্তু এক মাস পেরিয়ে গেলেও সেই টাকা আসেনি। তবে যা এল তা ভাবতেও পারেননি হাফিজুর রহমান। ৫ হাজার টাকা নয়, ৫টি সেলাই মেশিন কিনে দিলেন কাশেম সাহেব। যার তখনকার বাজার মূল্য প্রায় ২৫ হাজার টাকা। এরপর অভিভাবক হিসেবে পাশে দাঁড়ালেন মোস্তাক হোসেন। এভাবেই আস্তে আস্তে আলো আসতে শুরু করল। আর সেই আলোর পথ ধরে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে গিয়েছেন হাফিজুর রহমান।
 
বিশিষ্ট সাংবাদিক অনিলবরণ চ্যাটার্জী একবার তাঁকে নিউইয়র্কে নিয়ে যাবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। একটা সময় সাংবাদিক হতে চাওয়া হাফিজুর রহমান ব্যক্তিগত স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে সবিনয়ে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। বহু পদ অলংকৃত করা, বহু অপপ্রচার মুখ বুজে সহ্য করা হাফিজুর চান তাঁর প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মীগাছা জনকল্যাণ সংস্থার মাধ্যমে মেয়েরা স্বাবলম্বী হয়ে যেন সমাজকে দিশা দেখাতে পারে। তাদের দেখাদেখি সমাজের আরও মেয়েরা যেন এগিয়ে এসে এই সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে, তাতেই তাঁর শান্তি। 
 
এই প্রতিষ্ঠানকে ঠিকঠাকভাবে দাঁড় করানোর জন্য এখনও অনেক অর্থের প্রয়োজন। কোথা থেকে, কীভাবে সেই অর্থ আসবে জানেন না হাফিজুর। তবু তিনি আশাবাদী। মোস্তাক হোসেনের কাছ থেকে যে সহযোগিতা পেয়েছেন তা তিনি কখনও ভুলতে চান না। আবারও মোস্তাক সাহেবের কাছ থেকে সাহায্য পাবেন, এই আশা পোষণ করেন মনে মনে। প্রয়োজনে ভিক্ষার পাত্র নিয়েও মানুষের দরবারে যাবেন পাঁচ সন্তানের জনক হাফিজুর রহমান, সে কথাও জানালেন সোচ্চারে।
 
পবিত্র কোরআনের সূরা কাহাফের ১০৬ নম্বর আয়াত, সূরা লোকমানের ২৭ নম্বর আয়াতগুলো তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। তাই তাঁর জীবনে হতাশার কোনও জায়গা নেই। আল্লাহর নবী রসুল সা.এর সুন্নাত আর আল্লাহর প্রতি অগাধ ভরসা রেখেই সত্তর ছুঁই ছুঁই হাফিজুর রহমান এগিয়ে চলেছেন নতুন ভাবনাকে পাথেয় করে,আলোর পথের যাত্রী হয়ে।