একটি মহিলার করম পুজো করার একটি দৃশ্য
জিতিয়া করম, বুড়ী করম, রাস ঝুমুর হিসেবে পালিত এই উৎসব এর তাৎপর্যকে আরও গভীর করে তোলে। করম পুজো আসামের চা-জনগোষ্ঠীর মানুষের এক সার্বজনীন, জনপ্রিয় ও তাৎপর্যপূর্ণ উৎসব। প্রকৃতির প্রতি গভীর অনুরাগের পাশাপাশি কর্মমুখী চেতনা জাগ্রত করার দিকেও এটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। করম গাছকে কেন্দ্র করে উদযাপিত এই পুজোর মাধ্যমে পরম্পরাগত লোকবিশ্বাস ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রকাশিত হয়ে আসে। এই উৎসব মূলত কৃষিভিত্তিক উৎসব।
এই উৎসবে করম দেবতার পুজো করা হয়, যিনি শক্তি ও উৎপাদনক্ষমতার অধিকারী হিসেবে বিবেচিত। করম পুজো সাধারণত ভাদ্র মাসের শুক্ল একাদশীতে উদযাপন করা হয়। আসামে করম পর্ব বছরে তিন সময়ে পালিত হয়, ভাদ্র, আশ্বিন ও অঘ্রাণ মাসে। এই উৎসবের রীতি-নীতি অত্যন্ত পবিত্র। মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, সেটিকেই এখানে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
করম পুজো উপলক্ষে পরিবেশিত ঝুমুর নৃত্য
ভারতীয় সমাজজীবনে নারী সংস্কৃতির মাধ্যমে এক বিশেষ স্থান অর্জন করে এসেছে। এই উৎসবের মাধ্যমে নারীর প্রতি গুরুত্ব প্রদর্শন করাও আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক। করম পুজোর আচার-অনুষ্ঠানে কিশোরীরা প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে। এই কিশোরীদেরকে "করমতী" বলা হয়। করম জাওয়া করম পুজোর অন্যতম অনুষ্ঠান।
কয়েকদিন আগে থেকেই কুমারীরা উপবাস থেকে গান-নৃত্যের মাধ্যমে পুজোর জন্য প্রস্তুতি শুরু করে। একজন প্রবীণ বা পুরোহিত করম গাছের একটি ডাল কাটেন এবং গান-বাজনার মধ্য দিয়ে তা গ্রামে এনে পবিত্র স্থানে পুঁতে দেওয়া হয়। এটি উর্বরতা ও জীবনের প্রতীক। সেখানেই মূল পূজার আয়োজন করা হয় এবং দেবতার আশীর্বাদ প্রার্থনা করা হয়।
করম পুজো উপলক্ষে আলিপুরদুয়ার জেলার নদীর তীরে করম বিসর্জনের একটি দৃশ্য
এই উৎসবের সঙ্গে সঙ্গীত ও নৃত্যের একটি গভীর সম্পর্ক আছে। করম ও নৃত্য পুজোর আনন্দকে আরও বৃদ্ধি করে। ঝুমুর ও ঝুমুই গান-নৃত্যের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ঝুমুই গান ও নৃত্যের শুরুতে শ্রীহরি, ঢোল, মাদল, বজনারী প্রভৃতির উদ্দেশ্যে পরম্পরাগতভাবে গান পরিবেশিত হয়। এই গানগুলোতে ভারতীয় আধ্যাত্মিক জীবনের নানা কাহিনী বর্ণিত হয়। প্রহর অনুসারে ঝুমুই গানের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য থাকে।
করম পূজা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এর মাধ্যমে জনজীবনের গভীর তাৎপর্য প্রতিফলিত হয়। করম গাছ জীবন, বৃদ্ধি এবং মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে সম্পর্ককে প্রতীকায়িত করে। উপবাস নারীর ভক্তি ও আত্মসংযমকে নির্দেশ করে। জীবন, প্রকৃতি ও কর্মের মাধ্যমে উদ্ভাসিত করম পরব আদিবাসী সমাজের স্বকীয়তাকে প্রকাশ করে এসেছে। করম পর্ব শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, একই সঙ্গে সামাজিক সমতার বার্তাও প্রচার করে।

ঝাড়খণ্ডে করম পুজো উপলক্ষে শোভাযাত্রা
এই উৎসবের উৎপত্তির মধ্যে সমাজ–ধর্ম–অর্থনীতির নিবিড় সম্পর্ক গভীর হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গে বহু লোককাহিনি, পরম্পরা ও কিংবদন্তি বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে। প্রকৃতিপূজার পাশাপাশি উৎপাদন সংস্কৃতির ওপর গুরুত্ব দিয়ে যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়, তার মধ্যে করম গান ও নৃত্য এই উৎসবের সামাজিক জনপ্রিয়তার মূল চালিকাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই গানগুলির অধিকাংশই ঈশ্বর প্রার্থনা নয়, বরং সাধারণ মানুষের জীবন–অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রচিত। কিছু সংখ্যক গান ধর্মীয় সুরে ঈশ্বরকে প্রার্থনা জানালেও তা মূলত সাধারণ মানুষের সুখ–দুঃখ, বেদনা ও প্রেমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
করম গানের মাধ্যমে নারীদের একটি সুন্দর প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। করম জাওয়া গানে নারীর জীবনের কাহিনি, তাঁদের সংগ্রাম, আনন্দ, বিষাদ ও অন্তরের সরল অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়। সংস্কৃতির একটি বিস্তৃত দিক হলো প্রকৃতি, শস্য উৎপাদনের কামনা ও কর্মমুখী চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়। করম পূজার জনপ্রিয়তার ভিত্তি হলো লোকজীবনের প্রকাশ। মহান ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যে করম পরব যে বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে, তার ফলে সামাজিক ঐক্যের বৈশিষ্ট্যে একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।