শিক্ষার আলো পৌঁছে দিয়ে ইতিহাস গড়লেন সাফিনা হুসেন, পেলেন এশিয়ার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 1 d ago
এডুকেট গার্লস সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সাফিনা হুসেন (ফাইল)
এডুকেট গার্লস সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সাফিনা হুসেন (ফাইল)
 
মালিক আসগর হাশমি / নয়াদিল্লি

প্রাকৃতিক দুর্যোগের দাপটে দেশজুড়ে এখন উদ্বেগ আর অস্থিরতা, কোথাও বন্যার থাবা, কোথাও ভূমিধস, আবার কোথাও মেঘভাঙা বৃষ্টির তাণ্ডব। পত্রিকা থেকে শুরু করে টেলিভিশনের পর্দা, সবখানেই এইসব বিপর্যয়ের খবর শিরোনাম দখল করেছে। তবুও এই অস্থির সময়ের ভেতর থেকে উঠে এসেছে এক অনন্য আলো, যা ভারতের মুখ উজ্জ্বল করেছে গর্বে। এটি কোনো রাজনৈতিক জোট বা আর্থিক সাফল্যের খবর নয়, আবার কোনো খেলাধুলার বিজয়ের গল্পও নয়, এটি এক নারীর অদম্য ইচ্ছাশক্তি, তাঁর প্রতিশ্রুতি এবং শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ বদলে দেওয়ার সংগ্রামের কাহিনি। এই কাহিনি সাফিনা হুসেনের, যিনি তাঁর প্রতিষ্ঠান এডুকেট গার্লস–কে এমন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন যে এটি আজ ভারতের প্রথম অ-লাভজনক সংস্থা হিসেবে এশিয়ার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান রেমন ম্যাগসেসে পুরস্কার অর্জন করেছে।
 
দিল্লিতে জন্ম নেওয়া ৫৪ বছর বয়সি সাফিনা হুসেনের যাত্রাপথ অত্যন্ত অনন্য। লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর তাঁর সামনে ছিল আমেরিকা এবং ইউরোপে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার গড়ার বহু সুযোগ।
 
কিন্তু তিনি সবকিছু ছেড়ে ভারত ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ঠিক করেন, তিনি সেই প্রজন্মের জন্য কাজ করবেন যাদের সবচেয়ে বেশি উপেক্ষা করা হয়, গ্রামীণ এলাকার সেই সব কন্যাশিশু, যারা এখনও পর্যন্ত শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত।
 
সাফিনা হুসেন তাঁর সংস্থায় শিক্ষা প্রাপ্ত মেয়েদের সঙ্গে 
 
সাফিনার জীবন শুরু থেকেই সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত। তিনি দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা এবং এশিয়ার প্রান্তিক অঞ্চলে কাজ করেছেন এবং সেখানকার সমস্যাগুলো কাছ থেকে দেখেছেন। কিন্তু ভারতে ফিরে এসে তিনি বুঝতে পারেন, নিজের দেশেও মেয়েদের শিক্ষার অবস্থা ভয়াবহ। এই উপলব্ধিই তাঁকে ২০০৭ সালে মুম্বাই থেকে এডুকেট গার্লস–এর সূচনা করতে অনুপ্রাণিত করে।
 
প্রথমে এটি ছিল একটি ছোট্ট উদ্যোগ, যা রাজস্থানের জালোর জেলা এবং তার আশেপাশের গ্রামগুলোতে সীমাবদ্ধ ছিল। সাফিনা উপলব্ধি করেন, শিক্ষা মানে শুধু হাতে বই তুলে দেওয়া নয়, বরং সমাজের চিন্তাভাবনা ও প্রথাগুলোকেও পরিবর্তন করা।
 
তিনি দেখলেন, দারিদ্র্য, পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এবং সামাজিক চাপে পরিবারগুলো মেয়েদের স্কুলে পাঠানোকে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেয়। তিনি গ্রামেগ্রামে ঘুরে মানুষকে বোঝালেন, সমাজকে যুক্ত করলেন এবং বিশ্বাস জাগালেন যে কন্যাশিশুর শিক্ষা গোটা সমাজকে বদলে দিতে পারে। ধীরে ধীরে এই উদ্যোগ এক আন্দোলনে পরিণত হয়।
 
আজ এডুকেট গার্লস ৩০,০০০-এরও বেশি গ্রামে কাজ করছে এবং ২০ লক্ষেরও বেশি মেয়ের জীবন বদলে দিয়েছে। এই সংস্থা এখন পর্যন্ত ১১ লক্ষের বেশি কন্যাশিশুর নাম নথিভুক্ত করিয়েছে এবং ১.৫৫ কোটিরও বেশি মানুষকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে।
 
সাফিনা হুসেন 
 
এই কাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সাফিনা টিম বালিকা গড়ে তোলেন। এখানে স্থানীয় যুবক-যুবতীরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে গ্রামেগ্রামে ঘুরে স্কুলবিমুখ মেয়েদের খুঁজে বের করেন এবং তাদের পড়াশোনার জন্য অনুপ্রাণিত করেন।
 
সংস্থার সবচেয়ে বড় সাফল্যগুলির মধ্যে একটি হলো ২০১৫ সালের এক অভিনব পদক্ষেপ, যখন এটি শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বের প্রথম ডেভেলপমেন্ট ইমপ্যাক্ট বন্ড চালু করে। এই অনন্য মডেল আর্থিক সহায়তাকে সরাসরি মাপা যায় এমন ফলাফলের সঙ্গে যুক্ত করেছিল।
 
এর ফলস্বরূপ, সংস্থা তার ভর্তি এবং শিক্ষণ, উভয় লক্ষ্যই ছাড়িয়ে যায়। পরে এডুকেট গার্লস প্রগতি নামে একটি কর্মসূচি শুরু করে, যা ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী তরুণীদের ওপেন স্কুলিং-এর মাধ্যমে পড়াশোনা সম্পূর্ণ করার সুযোগ দেয়। এই উদ্যোগ প্রথমে মাত্র ৩০০ মেয়েকে নিয়ে শুরু হলেও আজ পর্যন্ত এটি ৩১,৫০০-রও বেশি তরুণীর কাছে পৌঁছে গেছে।
 
কোভিড-১৯ মহামারির সময় যখন গোটা দেশে ভয় এবং অনিশ্চয়তার পরিবেশ ছিল, তখনও এডুকেট গার্লস আশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গ্রামীণ এলাকার লাখো পরিবারে রেশন ও স্বাস্থ্যবিধি কিট পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে শিক্ষা সচল রাখতে ক্যাম্প বিদ্যা নামের উদ্যোগ চালু করা পর্যন্ত, সংস্থাটি প্রমাণ করেছে যে সংকটের সময়েও মেয়েদের পড়াশোনা থামানো যায় না।
 
এই শিবিরগুলোর মাধ্যমে ১৭,০০০-রও বেশি শিক্ষণ সেশন আয়োজন করা হয়েছিল, যেখানে ৩.৪ লক্ষেরও বেশি শিশু অংশগ্রহণ করেছিল।
 
 
এই পুরস্কারের ঘোষণা হওয়ার পর সাফিনা হুসেন বলেন, রেমন ম্যাগসেসে পুরস্কার অর্জনকারী প্রথম ভারতীয় অ-লাভজনক সংস্থা হওয়া শুধু এডুকেট গার্লস-এর জন্য নয়, বরং সমগ্র দেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
 
এই স্বীকৃতি ভারতে মেয়েদের শিক্ষার জন্য জন-চালিত আন্দোলনকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরে। তিনি বলেন, “এই জয় কেবল আমাদের সংস্থার নয়, বরং সেই লাখো মেয়েদের, যারা শিক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছে; সেই স্বেচ্ছাসেবকদের, যারা গ্রামে গ্রামে গিয়ে মেয়েদের স্কুলের সঙ্গে যুক্ত করেছে; আর সেই দাতাদের ও সহযোগীদের, যারা এই কাজকে এগিয়ে নিয়েছেন।”
 
সাফিনার ব্যক্তিগত জীবনও সমানভাবে আলোচিত। তিনি প্রয়াত অভিনেতা ইউসুফ হুসেনের কন্যা। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক হান্সল মেহতার সঙ্গে ১৭ বছর লিভ-ইনে থাকার পর ২০২২ সালে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দুই কন্যা রয়েছে, কিমায়া ও রেহানা। হান্সল মেহতা সবসময় সাফিনার সামাজিক কাজের পাশে থেকেছেন এবং তাঁর চলচ্চিত্রগুলিতেও সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলন দেখা যায়।
 
রেমন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড ফাউন্ডেশন তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে, এডুকেট গার্লস-কে এই সম্মান দেওয়া হয়েছে মেয়েদের ও তরুণীদের শিক্ষার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক গোঁড়ামিকে ভেঙে দিয়ে তাঁদের পূর্ণ মানবিক সম্ভাবনা অর্জনের সুযোগ দেওয়ার জন্য। প্রকৃতপক্ষে এই পুরস্কার সেই পরিবর্তনের স্বীকৃতি, যা কোনো রাজধানী বা বড় শহর থেকে নয়, বরং দূরবর্তী গ্রামের একাকী এক মেয়ের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল এবং ধীরে ধীরে সমগ্র সম্প্রদায়কে নতুন রূপ দিতে শুরু করে।
 
এডুকেট গার্লস-এর সি ই ও গায়ত্রী নায়ার লোবো বলেছেন, শিক্ষা হলো উন্নয়নের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার এবং এটি প্রতিটি মেয়ের মৌলিক অধিকার। তাঁর মতে, এই পুরস্কার সেই রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের স্বীকৃতি, যা সরকার, কর্পোরেট জগৎ, দাতব্য সংস্থা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে একযোগে সম্ভব হয়েছে।
 
সাফিনা হুসেন তাঁর সংস্থার শিশুদের সঙ্গে
 
আজ যখন ভারত নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, তখন এডুকেট গার্লস-এর এই কৃতিত্ব সমগ্র দেশের জন্য গর্বের বিষয়। এটি প্রমাণ করে যে পরিবর্তনের বীজ এক গ্রামের এক মেয়ের মধ্যেও নিহিত থাকতে পারে, যদি তাকে শিক্ষার আলো দেওয়া যায়।
 
আসন্ন বছরগুলোতে সাফিনা এবং তাঁর সংস্থার লক্ষ্য এক কোটিরও বেশি মেয়ের কাছে পৌঁছনো এবং এই আন্দোলনকে ভারতের বাইরেও বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে ছড়িয়ে দেওয়া। সাফিনার বিশ্বাস, যখন প্রতিটি মেয়েকে শিক্ষার সুযোগ দেওয়া যাবে, তখনই প্রকৃত সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে।
 
রেমন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড জিতে এডুকেট গার্লস প্রমাণ করেছে যে ভারতের পরিবর্তনের আসল নায়িকারা সেইসব মেয়েরা, যারা স্কুলে গিয়ে নিজেদের আগামীকে বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে। এই গল্প শুধু একটি পুরস্কারের নয়, বরং সেই বিশ্বাসের, যে শিক্ষা সমাজকে বদলে দেওয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি এবং যখন একটি মেয়ে পড়াশোনা করে, তখন তার সঙ্গে এগিয়ে যায় সমগ্র পরিবার, সমগ্র সমাজ এবং গোটা দেশ।