তিন হাজারের বেশি বিলুপ্ত বাংলা প্রবাদ প্রবচন সংগ্রহ করে নজির গড়েছেন পান্ডুয়ার ইমারন নাহার

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 2 d ago
ইমারন নাহার
ইমারন নাহার
 
দেবকিশোর চক্রবর্তী 

তখন ছিল বারো ঘর তেরো উঠোনের সংসার। যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা শৈশব ছিল অন্যরকম। নাতি নাতনিদের কাছে ডেকে রূপকথার গল্প শোনাতেন ঠাকুমা দিদারা । সে এক সময় ছিল তখন। যৌথ পরিবারে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে গত শতকের আটের দশক থেকেই। সেইসব 'রূপকথার গল্প বলা মানুষে'রা নিজেরাই এখন গল্প হয়ে গেছেন। জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শত শত রূপকথার গল্প মালা। হারিয়ে যাওয়া সেইসব শ্রুতি কথার গল্পমালা সংগ্রহ করছেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার পাণ্ডুয়া ব্লকের নীরব সংগ্রাহক ইমারন নাহার। প্রায় পাঁচ শতাধিক রূপকথার গল্প তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করেছেন। 
 
নব্য শিক্ষিত সমাজের উপেক্ষা ও উদাসীনতায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার হাজার হাজার প্রচলিত প্রবাদ প্রবচন। এক সময় যা মুখে মুখে ফিরতো। বাংলা প্রবাদ প্রবচনের বিপুল ভাণ্ডারের কিছু অংশ অবশ্যই স্থান পেয়েছে ব্যাকরণ বইতে। অধিকাংশই ছিল শ্রুতি নির্ভর। যা কেবল লোক মুখেই প্রচলিত ছিল। তিন হাজারেরও বেশি বিলুপ্তপ্রায় বাংলা প্রবাদ প্রবচন বহু কসরত করে উদ্ধার করেছেন কবি ও সংগ্রাহক ইমারন নাহার। 
 
কবি ও সংগ্রাহক ইমারন নাহার
 
দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতা থেকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটার দূরে হুগলি জেলার পান্ডুয়া ব্লকের রানাগড় গ্রামে তাঁর জন্ম। মুসলিম পরিবারে জন্ম হলেও শৈশব থেকেই একটা সাংস্কৃতিক পরিবেশ ছিল চারপাশে। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির অভ্যাস। কথা প্রসঙ্গে 'আওয়াজ দ্য ভয়েস'কে তিনি জানালেন, "আমার পিসিমা হামিদ উন্নেসা সেই শতবর্ষ আগে বৃত্তি পেয়েছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে স্কলারশিপ পান। ছেলেবেলায় সেই পিসির কাছেই রূপকথার গল্প শুনতাম। এক লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বরের জীবনী তিনি মুখে মুখে শোনাতেন।"
 
ইমারন নাহারের মা আনোয়ারা খাতুন ধর্মপ্রাণ মানুষ। সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি তাঁরও ছিল প্রগাঢ় উৎসাহ। নিজের সুপ্ত ইচ্ছেগুলো মেয়ের মধ্যে খানিকটা প্রভাবিত করেছিলেন তিনি। বাংলার হারিয়ে যাওয়া প্রবাদ প্রবচন সংগ্রহের বিষয়টি মা এবং পিসির কাছ থেকেই উৎসাহ পান। নিয়মিত লেখালেখির চর্চা করেন ইমারন নাহার। তাঁর সংগ্রহের রূপকথার গল্প মালা ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন পোর্টাল ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে তাঁর দু'টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তার লেখার বিষয় মূলত নারীর অধিকার। তিনি বিশ্বাস করেন মেয়েদের আর্থিক ও সামাজিক স্বাধীনতায়। সেই স্বাধীনতা যেন কোনো ভাবেই স্বেচ্ছাচারিতার রূপ না নেয়। 
 
সচ্ছল মুসলিম কৃষক পরিবারের গৃহবধূ ইমরান কথা প্রসঙ্গে 'আওয়াজ দ্য ভয়েস'কে জানালেন,"বাংলার সুপ্রাচীন রূপকথার গল্পমালাগুলো কিন্তু শুধুই বিনোদনের বিষয় ছিল না। মেয়েদের চিন্তা ও চেতনার সংস্কারের অনেক বার্তা সেই সব গল্পমালার পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে। সে সব কথামালা আমি তিল তিল করে সংগ্রহ করে জমিয়েছি। আর গ্রামীণ বাংলার প্রবাদ প্রবচন! সে সব যেন এক রত্ন ভাণ্ডার। পল্লী বাংলার প্রবীণ মানুষের মুখেমুখে ফিরত সেই সব। তিন হাজারেরও বেশি প্রবাদ আমার সংগ্রহে রয়েছে। কষ্ট করে হলেও সেগুলি আমি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে প্রকাশ করব ভাবছি।" তাঁর স্বপ্ন পূরণের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে একমাত্র মেয়ে অন্বেষা নার্গিস।
 
কলকাতা প্রেস ক্লাবে ইমারন নাহারের একটি ছবি 
 
ইমারন নাহারের সংগ্রহে রয়েছে গাঙ্গেয় দক্ষিণ বঙ্গ, রাঢ়বঙ্গ এবং মুসলিম সমাজে ব্যবহৃত প্রবাদ প্রবচন। তাঁর সংগ্রহে রয়েছে মুসলিম বিয়ের গান। ব্যক্তিগত আগ্রহে তিনি যে কাজ করে চলেছেন সেটি নিঃসন্দেহে এক কষ্টসাধ্য গবেষণার কাজ। কোনও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা তো দূর অস্ত, আঞ্চলিক কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠনও তার এই কর্মকাণ্ডে পাশে এসে দাঁড়ায়নি। 
 
তাঁর প্রথম কবিতার বই 'চাঁদের চিঠি' কবিতা প্রেমীদের মনে ধরেছিল। তারপরের কাব্যগ্রন্থ 'এক নদী জল, এক আকাশ আলো' জয় করেছিল পাঠক চিত্ত। তাঁর লেখার বিষয় নারীর সামাজিক অধিকার। তাঁর রচনা ইতিমধ্যেই মুসলিম সমাজে নারীদের মধ্যে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। বিভিন্ন নারী জাগরণ মঞ্চে নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে নারীদের অনুপ্রাণিত করার‌ জন্য ডাক পড়ে ইমারনের। তিনি বলেন, " আমি শুধু নিজের বা আমার পরিবারের মেয়েদের উন্নয়ন নিয়েই ভাবনা চিন্তা করি না। আমি প্রতিনিয়ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে মহিলাদের স্বনির্ভর করে তুলতে। নারীর হাতে কলম ধরিয়ে সেই কলমের জোরে তাদের পায়ের নীচের মাটি শক্ত করতে।"
 
তিনি আরো বলেন, "এখন আমাদের সমাজে মেয়েরা অনেক বেশি স্বনির্ভর ও সাহসী। আমাদের গ্রামেও এখন মেয়েদের জীবন যাপন অনেকটাই মসৃণ হয়েছে। মুসলিম মেয়েরা আরো বেশি শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে এবং স্বনির্ভর হচ্ছে। আমি সবসময় তাদের পাশে থেকে তাদের স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে বাঁচতে উৎসাহ দিতে চেষ্টা করি।  নতুন কিছু করতে প্রেরণা যোগায়। যতদিন বেঁচে থাকবো সমাজ ও নারীর উন্নতির জন্য লড়াই করে যাব।"
 
মেয়েদের উন্নয়নের কথা তিনি তাঁর কলমে তুলে ধরলেও তিনি বলেন, "আমি নারীবাদী নই, আমি মানবতাবাদী। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি তাদের নিজস্ব একটা জগত আছে। 'অর্ধেক আকাশ' কবিতার কয়েকটা লাইন খুব বলতে ইচ্ছে করছে: বন্দিনী মেয়েটাকে দাও গো বাঁধন খুলে, হাতা খুন্তির বদলে হাতে দাও কলম তুলে।"
 
ইমরান নাহার
 
ইমরান নাহার, এক নীরব প্রতিবাদী। কাগজ ও কলম তাঁর প্রতিবাদের মাধ্যম। সমসাময়িক বিষয়ের খোঁজ খবর রাখেন। তবে গ্রামের প্রান্তিক মানুষের দৈনন্দিন দুর্দশা তাঁকে ভাবায়। হুগলি জেলার পান্ডুয়া ব্লকের বেলুন ধামাসিনী গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত এক অখ্যাত গ্রামের বুক চিরে চলে গেছে ঘিয়াগী নদী। একদা কৃষি নির্ভর এই গ্রামটির জীবন রেখা এই নদী। সেই নদী আজ শুকিয়ে গরু বাঁধা দড়ির মতো হয়ে গেছে। বহু ফসলী চাষের জমি অনাবাদি হয়ে গেছে। 
 
চারপাশের এইসব বিষয়গুলি তাঁকে ভাবায়। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন,"সংবাদ মাধ্যমের নজর নেই প্রান্তিক মানুষের দুর্দশার দিকে। পাঞ্জাব হরিয়ানার কৃষকদের সমস্যা নিয়ে দিল্লিতে আন্দোলন হয়। জানেন গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের হাল বিগত দেড় দশকে খুব খারাপ হয়ে গেছে। সরকারি ঋণের ছিটেফোঁটাও গ্রামের প্রান্তিক মুসলমান কৃষকদের কপালে জোটে না। ফলে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে ডুবে যাচ্ছেন। সুদের টাকা দিতে দিতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। একশো দিনের কাজের ফাঁদে পা দিয়ে গ্রামের কৃষকরা এখন নিজেরাই শ্রমিক হয়ে গেছে।" 
 
শুধু ভাবনা নয়, তিনি এখন এই কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এই কাজে তাঁকে নিয়মিত উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যুগিয়ে চলেছেন তাঁর জীবনসঙ্গী,তাঁর সব সময়ের সহচর আব্দুল হান্নান।