ক্রিকেট ব্যাট বিক্রি করে জনপ্রিয় হওয়া খোয়াজা তাম্বোলি

Story by  atv | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 1 d ago
খোয়াজা তাম্বোলি তার বানানো বেট এর সঙ্গে
খোয়াজা তাম্বোলি তার বানানো বেট এর সঙ্গে
 
ফজল পাঠান
 
প্রত্যেকের জীবনে এমন একটি মুহূর্ত আসে, যখন ব্যক্তির জীবন বদলে যায়। পরিস্থিতি সবার কাছেই সুযোগ নিয়ে আসে, কিন্তু খুব অল্প কিছু মানুষই সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারে। যদি আপনি অবিরত চেষ্টা করেন এবং সততার সঙ্গে কাজ করে যান, তবে আপনি নিঃসন্দেহে সফল হবেন।
 
এমনই এক জীবন পরিবর্তনের সুযোগ পেয়েছিলেন উত্তর সোলাপুরের ওয়াডালা গ্রামের একটি সাধারণ পরিবারের সন্তান খোয়াজা তাম্বোলি। খোয়াজা কঠোর পরিশ্রম ও নিষ্ঠার মাধ্যমে নিজের স্বপ্ন গড়ে তুলেছেন। মায়ের সঙ্গে ক্রিকেট ব্যাটের ব্যবসা শুরু করে তিনি সাফল্যের পথে এগিয়ে গেছেন। এই লেখায় আমরা জানব খোয়াজা তাম্বোলির সাফল্যের গল্প, যা যুব উদ্যোগীদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।
 
শুরুর যাত্রা সম্পর্কে খোয়াজা বলেন,“প্রাথমিক ও হাইস্কুলের পড়াশোনা শেষ করে আমি কলেজে ভর্তি হয়ে রসায়ন বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করি। আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। গত ১৪ বছর ধরে বাবা কোনো কাজ করতে পারছিলেন না, ফলে মাকেই পুরো পরিবার সামলাতে হচ্ছিল। আমি যেকোনোভাবে টাকা উপার্জন করতে চেয়েছিলাম। মা-ও আমাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন।”
 
তিনি আরও বলেন,"ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ ছিল। সেই কারণেই আমি আগেও ক্রিকেট প্রতিযোগিতা দেখতে যেতাম, আর খেলোয়াড়দের ব্যাট আমাকে খুব আকর্ষণ করত। কলেজে পড়াকালীন এক অ্যালার্জির কারণে খেলাধুলায় বেশি মন দিতে পারিনি। কিন্তু এই ক্ষেত্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার স্বপ্ন ছিল। তাই একদিন হঠাৎ খেলাধুলার সরঞ্জামের একটি দোকান খোলার সিদ্ধান্ত নিই। মা সংসার চালাতে যে সামান্য টাকা জমিয়েছিলেন, সেই সঞ্চয়ের সবটাই আমাকে দিয়ে ব্যবসা শুরু করতে সাহায্য করেন। আমি সেই দোকান থেকেই বিভিন্ন কোম্পানির ট্র্যাকপ্যান্ট, টি-শার্ট এবং ব্যাট বিক্রি করতাম।"
 
খোয়াজা তাম্বোলি নির্মিত ক্রিকেট বেট
 
উল্লেখ্য, খোয়াজার বাবা আজমালুদ্দিন তাম্বোলি আগে মালা ও গহনা তৈরি এবং বিক্রির ব্যবসা করতেন। ১৪ বছর আগে তিনি মানসিক রোগে আক্রান্ত হন এবং তখন থেকে তিনি কাজ করতে পারেননি। খোয়াজার মা পরিবারের ছোট ছোট সামগ্রী বিক্রি করে সাপ্তাহিক বাজার থেকে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
 
খোয়াজা বলেন,“আমি গরিব বলে কখনও স্বপ্ন দেখতে ভুলি নি। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখার বদলে আমি চোখ খোলা রেখেই কিছু স্বপ্ন দেখতাম। প্রত্যেকেরই স্বপ্ন দেখা উচিত, এবং সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা উচিত। সততা আর কঠোর পরিশ্রম করলে আপনার স্বপ্নগুলো অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে।”
 
যেকোনো ব্যবসা শুরু করার সময় সব কিছু গভীরভাবে চিন্তা করে করতে হয়। ব্যবসা করতে গেলে বহু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। সেইসব সমস্যা অতিক্রম করে নিজের লক্ষ্যপথে এগিয়ে যেতে হয়। ব্যবসা শুরুর অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে খোয়াজা বলেন,“আমার মা আমাকে কিছু টাকা দিয়েছিলেন, আর আমি ‘কে টি ব্যাটস’ নামে একটি ব্যবসা শুরু করি। সেই ব্যবসায় আমি ব্যাট বিক্রি করতাম। তখন কিছু বড় কোম্পানি আমাকে বলেছিল, আপনি যদি বড় পরিমাণে মাল কিনতে পারেন, তবেই আমরা আপনাকে পণ্য সরবরাহ করব। কিন্তু তখন আমার হাতে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। অর্থের অভাব তখন সত্যিই বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি দোকানে স্টক বাড়াতে চেয়েছিলাম, কিন্তু কিছুই করতে পারছিলাম না।”
 
তিনি আরও বলেন,“আমি দোকানটি বড় করতে আরও বেশি টাকা উপার্জন করতে চেয়েছিলাম। তাই টি-শার্ট ছাপার কাজ শুরু করি। উৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন মানুষ আমাকে টি-শার্ট ছাপার অর্ডার দিতে শুরু করেন, যার ফলে আমি ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হই। তখন আমার মনে হয়েছিল, আমি নিজেই স্টিকার তৈরি করব এবং যেসব ব্যাটে স্টিকার ছিল না, সেগুলিতে নিজের তৈরি স্টিকার লাগিয়ে বিক্রি করব।
 
কিন্তু সমস্যা ছিল এই যে, ব্যাটগুলো গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি ছিল না। ফলে সেই পণ্যের বিক্রি হচ্ছিল না।”
উদ্যমী এই ব্যবসায়ী আরও বলেন,“আমি বড় কিছু করতে চেয়েছিলাম। বাজারে গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাট পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই আমি নিজে মেশিন কিনে ব্যাট তৈরির কথা ভাবলাম। এই পরিকল্পনা নিয়ে কাশ্মীরে গেলাম এবং কিছুদিন সেখানে থেকে ভালো ব্যাট বানাতে যে ধরনের কাঠ লাগে, তা খুঁজে দেখলাম। সেখানে আমি ব্যাট তৈরির মেশিন চালাতে শেখার সুযোগও পাই।
 
খোয়াজা তাম্বোলি বেট নির্মাণ করা স্থানের এক দৃশ্য
 
পরে গ্রামে ফিরে এসে সেই মেশিনটি কিনি। যখন আমি নিজে ব্যাট তৈরি করতে শুরু করি, তখন থেকেই গ্রাহকদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেতে শুরু করি। আমার নিজের তৈরি ব্যাটের বিক্রি বাড়তে থাকে, আর তখন থেকেই আমাদের প্রকৃত ব্যবসার শুরু হয়।”
 
খোয়াজার মা রাশিদা এই ব্যবসা সম্পর্কে বলেন,“ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহী ছিল। সে শুরু থেকেই কঠোর পরিশ্রম করত এবং যেভাবে সম্ভব আমাকে সাহায্য করত। তার দৃঢ়তা দেখে আমি জীবনের সমস্ত সঞ্চয় তার ব্যবসা বিস্তারের জন্য ব্যয় করেছি। আমি সন্তুষ্ট যে খোয়াজা আমার বিশ্বাসকে সঠিক প্রমাণ করেছে।”
 
উল্লেখযোগ্য যে, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, উত্তর প্রদেশ, ছত্তিশগড়, গুজরাট, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি রাজ্যের খেলোয়াড়দের মধ্যে খোয়াজা প্রস্তুত করা ব্যাটগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয়। খেলোয়াড়দের পছন্দ অনুযায়ী ব্যাট তৈরি করে দেওয়া হয়।
 
এই বিষয়ে তিনি বলেন,“যখন আমি পড়াশোনা করছিলাম, তখনই উপলব্ধি করেছিলাম যে খেলোয়াড়দের বিভিন্ন ধরণের ব্যাটের প্রয়োজন হয়। যেমন যদি কোনো খেলোয়াড় মাঠের সবদিক,অর্থাৎ ৩৬০ ডিগ্রি জুড়ে খেলার ইচ্ছে রাখে, তাহলে তার জন্য প্রয়োজন পড়ে ৯৭০ গ্রাম ওজনের ব্যাট। যদিও সবাই এই ওজনের ব্যাট ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু যদি কোনো খেলোয়াড় শুধু ‘V’ আকৃতির এলাকা, অর্থাৎ সামনের দিকে খেলে, তাহলে তার জন্য ১০৩০ থেকে ১০৫০ গ্রাম ওজনের ব্যাটের প্রয়োজন হয়।” 
 
তিনি আরও বলেন,“আমি দারিদ্র্যকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। অনেক সময় খেলোয়াড়দের হাতে নতুন ব্যাট কেনার মতো টাকা থাকে না। এমন খেলোয়াড়দের জন্য আমি কম দামে ব্যাট তৈরি করি। শুধু টাকার অভাবে আমি কাউকে থামিয়ে দিই না। আমি উচ্চাকাঙ্ক্ষী খেলোয়াড়দের আমার স্টিকারের সঙ্গে ব্যাট দিয়ে সাহায্য করি। সম্প্রতি গুজরাটের এক খেলোয়াড়কে ‘প্লেয়ার এডিশন’ ব্যাট উপহার হিসেবে দিয়েছি।”
 
বর্তমান ব্যবসার অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন,“আমি কাশ্মীর থেকে কাঁচামাল এনে ব্যাট তৈরি করি। বর্তমানে আমি প্রতি মাসে ১০০ থেকে ২০০টি ব্যাট বিক্রি করি। ‘কেটি এডিশন’ এবং ‘প্লেয়ার এডিশন’-এর দাম ৩৫০০ টাকা, আর ‘গোল্ড এডিশন’-এর দাম ৩০০০ টাকা। আগামী দিনে আমি আমার ব্যাটের ব্যবসা দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। আমি নিজের একটি ব্র্যান্ড তৈরি করতে চাই। প্রতিটি রাজ্যে আমার ব্র্যান্ডের ব্যাট পৌঁছানোই আমার এক বড় স্বপ্ন।”