বিহার বিধানসভা নির্বাচন ২০২৫: মুসলিম প্রতিনিধিত্বে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 11 h ago
বিহার নির্বাচনী প্রচারণা তুঙ্গে
বিহার নির্বাচনী প্রচারণা তুঙ্গে
 
মালিক আশগর হাসমি / নয়াদিল্লি

বিহার বিধানসভা নির্বাচন ২০২৫ ঘিরে রাজনৈতিক উত্তাপ তুঙ্গে। সব রাজনৈতিক দলই এখন শেষ পর্যায়ের প্রচারে ব্যস্ত। তবে এবারের নির্বাচনের সবচেয়ে আলোচিত দিক হলো, মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের প্রশ্ন। এই ইস্যুতে নিজেদের সবচেয়ে বড় দাবিদার হিসেবে তুলে ধরছে বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চা। বিস্ময়ের বিষয়, বিজেপি এবারও একজনও মুসলিম প্রার্থী দেয়নি, তবুও তারা তথাকথিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ দলগুলোকেই আক্রমণের মূল নিশানা করছে।  
 
সংখ্যালঘু মোর্চার অভিযোগ, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো রাজ্যের ১৮ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যাকে শুধু দূরে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, কিন্তু ক্ষমতার প্রকৃত অংশীদারিত্ব থেকে তাদের বঞ্চিত রাখে। বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চা জানিয়েছে যে তারা বিহারের ১২,০০০-রও বেশি প্রভাবশালী বুথে মুসলিম ভোটারদের এই বৈষম্য বোঝাতে বড়সড় কৌশল গ্রহণ করেছে।
 
প্রতীকী ছবি
 
তারা মুসলিম ভোটব্যাংককে বোঝাতে চাইছে যে, যেসব দলকে মুসলমানরা দশকের পর দশক ধরে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সমর্থন দিয়ে আসছে, সেই দলগুলোই মুসলিম নেতৃত্বকে প্রকৃত সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। এই প্রচারের অংশ হিসেবে মোর্চা কেবল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের উন্নয়নমূলক কাজের কথাই বলছে না, বরং আরজেডির মতো দলগুলোর সমালোচনাও করছে, যারা কখনও তাদের সিনিয়র মুসলিম নেতাকে মুখ্যমন্ত্রী বা উপ-মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসায়নি।
 
গিরিরাজ সিংয়ের ‘নমক হারাম’ মন্তব্য ও দলীয় দ্বন্দ্ব

বিজেপির নির্বাচনী কৌশলের এই দিকটি দলটির অভ্যন্তরীণ মতবিরোধকেও প্রকাশ করছে। একদিকে সংখ্যালঘু মোর্চা মুসলিম সমাজের মধ্যে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং প্রকাশ্যে বলেছেন, “মুসলমানরা নমক হারাম, তারা বিজেপিকে ভোট দেয় না।”
 
এই মন্তব্য শুধু সংখ্যালঘুদের মধ্যে ফ্রন্টের প্রচেষ্টাকেই দুর্বল করেনি, বরং পুরো এনডিএ জোটের জন্যও তা ক্ষতিকর হয়েছে। জনতা দল (ইউনাইটেড) ও চিরাগ পাসওয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি মুসলিম প্রার্থী দিয়েছে এবং তাদের বড় অংশ মুসলিম ভোটও পেয়েছে। তাই গিরিরাজ সিংয়ের এই বক্তব্য এনডিএর সামাজিক সমীকরণে ফাটল ধরাতে পারে।
 
বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার জাতীয় সভাপতি জামাল সিদ্দিকি দলের সিনিয়র নেতার এই মন্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, “গিরিরাজজি বড় নেতা, কিন্তু মোদিজির নীতি স্পষ্ট, যারা ভোট দেয় তারা আমাদের, আর যারা দেয় না তারাও আমাদের। কেউ যদি ভোট না-ও দেয়, তাকে নমক হারাম বলা উচিত নয়।”

তিনি আরও বলেন, “যদি গিরিরাজজি অনুতপ্ত হন, তবে তার উচিত হবে অবসর নেওয়া।” এই মন্তব্য বিজেপির ভেতরে “সবকা সাথ, সবকা বিকাশ” মতাদর্শ এবং কঠোর হিন্দুত্ববাদী ধ্যানধারণার মধ্যে চলা টানাপোড়েনের ইঙ্গিত দেয়।
 
বিজেপির যুক্তি: ‘সম্প্রদায় নয়, জয়ের সম্ভাবনা’ই মুখ্য

জামাল সিদ্দিকি বলেন, বিজেপি ধর্ম বা সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে রাজনীতি করে না। দলের একমাত্র মানদণ্ড হলো, কে নির্বাচনে জয়ী হতে পারেন। তাই মুসলিম প্রার্থী না দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলার যুক্তি নেই।
 
তিনি বলেন, উন্নয়ন এবং কল্যাণমূলক প্রকল্পের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নীতি স্পষ্ট, সরকার কোনো ধর্ম বা জাতির নয়, বরং উন্নয়নের সুবিধা সবার জন্য। এনডিএ সরকারের অধীনে মুসলমানরা ঘর, আয়ুষ্মান কার্ড এবং আইনের সুরক্ষা পেয়েছে, যা ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য উন্মুক্ত।
 
এনডিএ-র অংশীদারিত্বের দাবি

যেহেতু বিজেপি একা নয়, এনডিএর সহযোগিতায় ভোটে নামছে, তাই সিদ্দিকি বলেন, “এই বিষয়টি শুধু বিজেপির নয়, পুরো জোটের প্রেক্ষিতে দেখা উচিত।”
 
তিনি জানান, এনডিএ মোট ২৪৩ আসনের মধ্যে ৫ জন মুসলিম প্রার্থী দিয়েছে, যার মধ্যে বেশিরভাগই পিছিয়ে পড়া শ্রেণির (পসমান্দা) মুসলিম। জেডিইউ-এর ৪ জন মুসলিম প্রার্থীর মধ্যে ৩ জনই পসমান্দা, যা বিজেপির নতুন রাজনৈতিক কৌশলের প্রতিফলন।
 
ইন্ডিয়া জোটের বিরুদ্ধে অভিযোগ: ‘সন্তুষ্টি’ আর ‘বঞ্চনা’
 
বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার প্রধান লক্ষ্য, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর মুখোশ উন্মোচন। সিদ্দিকি প্রশ্ন তোলেন, “বিহারে ১৮% মুসলমান ভোটার থাকলেও মহাজোট কেন যথেষ্ট মুসলিম প্রার্থী দেয়নি, কিংবা উপ-মুখ্যমন্ত্রী পদে কোনো মুসলিম নেতাকে প্রস্তাব করেনি?”
 
তিনি বলেন, “যদি যাদবরা (১৪%) মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেন এবং ৩% অন্য জাতির কেউ উপ-মুখ্যমন্ত্রী হন, তবে ১৮% মুসলমান কোথায় যাবে?”
 
গত নির্বাচনে আরজেডির সিনিয়র নেতা আবদুল বারী সিদ্দিকিকে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী করার দাবি উঠেছিল। এবারে সেই দাবি আবারও উঠেছে। খবর অনুযায়ী, তেজস্বী যাদবের ‘চাহনশাহ’ মন্তব্যেও আবদুল বারী সিদ্দিকি অসন্তুষ্ট।
 
তৃণমূল পর্যায়ে ১২,০০০ বুথে অভিযান
 
জামাল সিদ্দিকি জানান, বিহারের প্রায় ১২,০০০টি বুথে যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা বেশি, সেখানে “এক বুথ, দশজন সংখ্যালঘু যুবক” নামে একটি তৃণমূল অভিযান শুরু হয়েছে। এই কর্মীরা ঘরে ঘরে গিয়ে মোদি ও নীতীশ সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মসূচি তুলে ধরছেন এবং ইন্ডিয়া জোটের মুসলিম অবহেলার বিষয়টিও ব্যাখ্যা করছেন। সিদ্দিকির দাবি, “এখন মুসলমানরা বুঝতে পারছেন যে মহাজোট শুধু তাদের ব্যবহার করেছে।”
 
প্রতীকী ছবি
 
শেষ পর্যন্ত বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার সভাপতি স্পষ্ট জানিয়ে দেন, দলটি বিহারের মুসলমানদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে এনডিএর পক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। তাদের লক্ষ্য মুসলিম ভোটারদের বোঝানো যে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে তাদের বহু বছর ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা হয়েছে। যদিও বিজেপি এবারও মুসলিম প্রার্থী দেয়নি, তবু উন্নয়নমূলক প্রকল্প, সামাজিক সুরক্ষা ও সহযোগী দলগুলোর মাধ্যমে মুসলমানদের মর্যাদা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার দাবি করছে দলটি।
 
এইভাবে বিজেপি এমন এক নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি করতে চাইছে, যেখানে মুসলিম প্রার্থী ছাড়াও মুসলিম ভোট জেতা সম্ভব হবে, এবং সেই লক্ষ্যেই তারা ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর মুসলিম রাজনীতিকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। ফলে, বিহারের নির্বাচনে মুসলিম প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি এখন কেবল পরিচয়ের রাজনীতি নয়, বরং ক্ষমতা, সুযোগ ও বাস্তব প্রভাবের নতুন সমীকরণে রূপ নিয়েছে।