জেব আখতার
ঝাড়খণ্ডের রাজধানী রাঁচির ব্যস্ত রাস্তাগুলির আড়ালে লুকিয়ে আছে এমন এক নাম, যিনি নিঃশব্দে হাজারো জীবনে আলো জ্বালিয়েছেন, মোহাম্মদ মিনহাজ। তবে প্রথম দর্শনে তাঁর ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেই অগ্নিশিখার আভাস পাওয়া কঠিন, যা তাকে টানা ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সমাজসেবায় অনুপ্রাণিত করে চলেছে। সরল মুখশ্রী, শান্ত কণ্ঠস্বরের এই মানুষটি আসলে এক শক্তি, যিনি রাঁচির বস্তিগুলিতে আশার নতুন আলো জ্বালিয়েছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অধিকার নিয়ে লড়াইকে তিনি জীবনের মিশন বানিয়েছেন, আর বিনা বিরতিতে আজও সেই মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
১৯৮২ সালে তাঁর এই যাত্রা শুরু হয়। তখন রাঁচি শহর আগ বাড়ছিল ঠিকই, কিন্তু তার বস্তিগুলি ছিল অন্ধকারে ঢাকা। দিনভর মজুরি করা শ্রমিক ও রিকশাচালক পরিবারগুলি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুধুই দু’মুঠো ভাতের যোগাড়ে ব্যস্ত থাকত। পড়াশোনা তাদের কাছে স্বপ্নের মতো ছিল। তখনই মিনহাজ সিদ্ধান্ত নেন, পরিবর্তনের ভিত্তি হবে শিক্ষা। তিনি গরিব এলাকাগুলিতে ‘নাইট ক্লাস’ চালু করেন। দিনভর কাজ করে ক্লান্ত শ্রমিকরা যখন কুঁড়েঘরে ফিরতেন, বিশ্রামের খোঁজ করতেন, তখন মিন্নাজ তাদের কাছে যেতেন এবং পড়াতে শুরু করতেন।
মোহাম্মদ মিনহাজ
এ কাজ সহজ ছিল না। অনেকে হেসে বলত, “আমাদের পড়ে কী হবে, আমাদের তো পেট চালাতে হয়।” কিন্তু মিনহাজ ধৈর্য ধরে বুঝিয়ে বলতেন, “শিক্ষাই তোমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেবে।” ধীরে ধীরে মানুষ তা বুঝতে শুরু করে, আর বস্তির রাতের আলো শুধু লণ্ঠনের নয়, শিক্ষার আলোতেও ঝলমল করতে থাকে।
অল্প দিনের মধ্যেই তিনি বুঝলেন, প্রকৃত পরিবর্তন হবে শিশুদের শিক্ষার মাধ্যমে। যদি বাচ্চারা স্কুলে যায়, তবেই সমাজের চেহারা বদলাবে। সেই উদ্দেশ্যে তিনি রাজধানীর বস্তিগুলির একটি বিস্তারিত সমীক্ষা চালান। ডোমটোলি, হরিজন টোলা, গড়হা টোলি, গুদগুড়ি মহল্লা, কদরু টোলি, ইলাহি নগর ও ইসলাম নগরের মতো এলাকায় পৌঁছে যান তিনি, যেসব জায়গায় তখন মানুষ নাক চেপে চলতেও কুণ্ঠিত হতো। কিন্তু মিনহাজ সেখানে পৌঁছে পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন এবং শিশুদের স্কুলে পাঠানোর অভিযান শুরু করেন।
ক্রমে সহযাত্রীও যুক্ত হয়। YMCA সাহায্যের হাত বাড়ায়, পরে জার্মান সংস্থা CVJM থেকেও সমর্থন আসে। ধীরে ধীরে তার উদ্যোগ রূপ নিতে শুরু করে। অনেক সময় তিনি নিজে বাচ্চাদের হাত ধরে স্কুলে নিয়ে যেতেন, কখনও বাচ্চার পছন্দমতো স্কুল বেছে নিয়ে ভর্তি করাতেন। ফলস্বরূপ, ৯০-এর দশক নাগাদ শহরের ৩৪টি নামী স্কুলে ৪ থেকে ৫ হাজার গরিব শিশু পড়াশোনা শুরু করে। আজ সেই শিশুরাই কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ প্রফেসর, কেউ সরকারি আধিকারিক। যখন মিনহাজ তাদের সাফল্যের গল্প শোনেন, তখন তার মুখের আনন্দের আলো যে কোনো বড় পুরস্কারের চেয়েও উজ্জ্বল লাগে।
একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়া মুহূর্তে মোহাম্মদ মিনহাজ
এত বড় কাজ সামলানো সহজ ছিল না। এজন্য তিনি বস্তিগুলিতে দুটি কমিটি গঠন করেন, “লোকাল কমিটি” ও “মহিলা মণ্ডল”। লোকাল কমিটিতে এলাকার যুবক ও পুরুষরা থাকত, যারা এলাকার চাহিদা জানাত ও বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে সহায়তা করত। মহিলা মণ্ডলের সদস্যারা ঘরে ঘরে গিয়ে মায়েদের বোঝাতেন এবং শিশুদের পড়াশোনায় আগ্রহী করতেন।
খরচের মডেলও ভেবেচিন্তে তৈরি হয়েছিল, কিছু অর্থ YMCA থেকে, কিছু তাঁর বন্ধুদের কাছ থেকে, আর সামান্য অংশ অভিভাবকদের কাছ থেকে নেওয়া হতো। উদ্দেশ্য ছিল, অভিভাবকরাও দায়িত্ববোধ অনুভব করবেন এবং শিক্ষাকে বিনামূল্যের জিনিস বলে ভাববেন না। শিক্ষার ভিত্তি শক্ত হলে মিনহাজ স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কাজ শুরু করেন। তিনি ডাক্তার, ওষুধ বিক্রেতা ও মেডিক্যাল প্রতিনিধি, সবাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং মাসে একবার বস্তি এলাকায় বিনামূল্যের স্বাস্থ্য শিবির শুরু করেন। ধীরে ধীরে এই উদ্যোগও শক্ত ভিত্তি পায়। অসুস্থ শিশু ও বৃদ্ধরা চিকিৎসা ও ওষুধ পেতে শুরু করে। আজও এই কাজ অব্যাহত।
দুই দশকেরও বেশি সময় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার পর মিনহাজ বুঝলেন, গরিব মানুষ শুধু নিরক্ষর বা অসুস্থই নয়, তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কেও সম্পূর্ণ অজ্ঞ। তাদের জানা নেই, তাদের সন্তানদের বিনামূল্যে শিক্ষার অধিকার আছে, রাস্তার ধারে দোকান উচ্ছেদ করা যায় না, কিংবা সরকারি প্রকল্প তাদের জন্যই তৈরি। এই ঘাটতি পূরণের জন্য তিনি নতুন পদক্ষেপ নেন, “অ্যাওয়ারনেস বিল্ডিং কমিটি” গঠন করেন। প্রতিটি কমিটিতে থাকত ১১ জন সদস্য, যাদের কাজ ছিল শুধু একটাই, মানুষকে তাদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করা। ধীরে ধীরে শহর ও আশপাশের বস্তিগুলিতে এমন ৩০-৩৫টি কমিটি গড়ে ওঠে। আজ এই কমিটিগুলি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, বাসস্থান এবং আইনি অধিকার নিয়ে গরিব মানুষকে সচেতন করছে।
বস্তির শিশুদের সঙ্গে মোহাম্মদ মিনহাজ
২০১৮ সালে মিনহাজ আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেন। কিন্তু তাঁর কাছে অবসর নেওয়া কেবল একটি শব্দমাত্র। তিনি বলেন, “যতদিন শক্তি আছে, আমি অবসর নিতে পারব না। সেবার কোনো রিটায়ারমেন্ট নেই।” সেই কারণেই আজও তিনি কমিটিগুলিকে পরামর্শ দেন, বস্তিতে যান, আর প্রয়োজনে প্রতিটি ফ্রন্টে নিজে দাঁড়িয়ে যান। এর পাশাপাশি তিনি শুধু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। পানি-সংকটে ভোগা এলাকাগুলিতে কুয়ো ও চাপকল স্থাপনেও কাজ করেছেন। এর জন্য তিনি “জন-অংশগ্রহণ” মডেল গ্রহণ করেন, অর্থ যদি বাইরে থেকে আসে, তবে এলাকার মানুষ অন্তত শ্রম দান করবেই। তাঁর বিশ্বাস, মানুষ যদি নিজে পরিশ্রম করে, তবে কাজের গুরুত্ব বুঝবে এবং সেটিকে যত্নে রাখবে।
আজ মিনহাজ সাহেবের গল্প প্রমাণ করে যে পরিবর্তন আনতে বড় ক্ষমতা বা পদ প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন শুধু উদ্দীপনা, সততা ও ধৈর্যের। তিনি একা শুরু করেছিলেন, কিন্তু তার সঙ্গে এক বিশাল কারওয়ান যুক্ত হয়েছে। হাজারো শিশুর জীবন বদলেছে, বস্তিতে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছেছে, আর মানুষ নিজেদের অধিকার চিনতে শিখেছে। যখন মিনহাজ হাসিমুখে বলেন, “আমি কিছুই করিনি, সমাজ মিলে করেছে, আমি তো শুধু এক মাধ্যম ছিলাম,” তখন তার বিনয় আরও বড় হয়ে ওঠে। আসলে, এঁরাই সত্যিকারের নায়ক, যারা নিঃশব্দে পরিশ্রম করে মানুষের জীবনে আলো আনে, আর তারপর নীরবে সরে গিয়ে বলে, “এ কাজ আমি করিনি, সমাজ করেছে।”