বিচারপতি রাজিন্দর সাচার নেতৃত্বাধীন কমিটি, ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত অবস্থার উপর তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, “যদিও ঘেটোতে বসবাস মুসলমানদের তাদের সংখ্যাগত শক্তির কারণে নিরাপত্তার অনুভূতি দেয়, এটি সম্প্রদায়ের পক্ষে মোটেই সুবিধাজনক নয়। দেখা গেছে, মুসলমানরা একত্রে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাসের ফলে (ঐতিহাসিক কারণ এবং নিরাপত্তাহীনতার গভীরতর অনুভূতির কারণে) তারা পৌর ও সরকারি সংস্থাগুলির অবহেলার সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় জল, নিকাশী, বিদ্যুৎ, বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ব্যাংকিং পরিষেবা, আঙ্গনওয়াড়ি, রেশন দোকান, রাস্তা এবং পরিবহন ব্যবস্থা সবই অপ্রতুল।”
রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলকে শপথ বাক্য পাঠ করানোর একটি মুহূর্তের ছবি
“ক্রমবর্ধমান ঘেটোয়াইজেশনের প্রেক্ষাপটে, এই পরিষেবাগুলির অনুপস্থিতি মুসলিম মহিলাদের উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে, কারণ তারা ‘নিরাপদ’ পাড়ার বাইরে যেতে অনিচ্ছুক, ফলে অন্যান্য জায়গা থেকে এই সুবিধা পেতে পারে না। মুসলিম সমাজের এই ক্রমবর্ধমান ঘেটোয়াইজেশন তাদের জনপরিসরের জায়গাকে সঙ্কুচিত করছে, যা এক বিপজ্জনক ও অস্বাস্থ্যকর প্রবণতা।”
বুদ্ধিজীবী, বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদদের মতে, মুসলমানদের ঘেটোয়াইজেশন বা গণ্ডিত অবস্থান ভারতের বৃহত্তম ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সামগ্রিক বিকাশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে, এ বিষয়ে প্রায় সকলেই একমত। এই প্রক্রিয়া শুরু হয় স্বাধীনতার অনেক আগেই, বিশ শতকের গোড়ার দিকে, যখন শহুরে এলাকায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বেড়ে ওঠে। তখন থেকেই বিভাজন শুরু হয়, এবং তা আরও প্রকট আকার ধারণ করে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর। মুসলমানরা ‘নিজেদের মধ্যে’ থাকতে চেয়েছিল, আবার হিন্দুরা ‘অন্যদের’ নিজেদের এলাকায় চায়নি।
তৎকালীন বেশিরভাগ ভারতীয় রাজনীতিক, যার মধ্যে জওহরলাল নেহরু-ও ছিলেন, এই প্রবণতাকে এক প্রকার স্বাভাবিক ইচ্ছা বলে মনে করতেন। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, মুসলমানদের নিজেদের ‘নিরাপদ স্থান’ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এর সঙ্গে একমত ছিলেন না। শুরু থেকেই তিনি ‘একটি সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক এলাকা’ ধারণার বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর মতে, এমন নীতি অবশেষে একটি সম্প্রদায়কে ঘেটোয়াইজেশনের দিকে ঠেলে দেবে এবং তাদের জাতীয় জীবনের মূল স্রোতে সংহত হওয়া বন্ধ করবে।

দেশভাগের পর, যখন হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অদলবদল হচ্ছিল, তখন দিল্লিতেও শরণার্থীদের ঢল নামে। ১৯৪৭ সালের ২১ নভেম্বর, জওহরলাল নেহরু সর্দার প্যাটেলকে চিঠি লিখে বলেন যে, মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় যেসব বাড়ির মালিক পাকিস্তানে চলে গেছেন, সেই বাড়িগুলি অমুসলিমদের বরাদ্দ না করা হোক। তাঁর আশঙ্কা ছিল, এতে সমস্যা তৈরি হতে পারে এবং মুসলমানরা অমুসলিমদের মধ্যে বসবাসে নিরাপদ বোধ করবেন না। সর্দার প্যাটেল জবাব দেন যে, তিনি শহরে মুসলমান ও হিন্দুদের জন্য আলাদা পকেট তৈরির পক্ষে নন। তাঁর মতে, এতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ বাড়বে এবং যোগাযোগ কমে যাবে। তবে তিনি একমত ছিলেন যে, বাড়ি বরাদ্দের সময় ধর্ম নয়, বরং প্রার্থীর চরিত্র যাচাই করা প্রয়োজন।
১৯৪৭ সালের ৯ ডিসেম্বর, কেসি নিয়োগীকে এক চিঠিতে প্যাটেল লিখেছিলেন, শরণার্থী ও দাঙ্গা-ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কেবল তাদের নিজ ধর্মের সরকারি কর্মচারী বা পুলিশ নিয়োগ করার পরামর্শে তিনি একমত নন। এমন ব্যবস্থা সমাজে আরও বিভাজন তৈরি করবে বলে তাঁর মত ছিল। সরকারের নীতি কখনোই এই ধর্মীয় ফাটলকে আরও গভীর করতে পারে না। সর্দার প্যাটেল সম্পর্কে প্রায়ই যে অভিযোগ তোলা হয় যে, তাঁর নীতিগুলি মুসলমানদের বিরোধী ছিল, তা বাস্তবসম্মত নয়। তাঁর চিন্তাধারা স্পষ্টভাবে দেখায়, তিনি বিশ্বাস করতেন যে হিন্দু-মুসলমান মিশ্র সমাজে একসঙ্গে বাস করলেই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ ভারত গড়ে উঠবে।
১৯৪৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ প্যাটেলকে লিখেছিলেন যে, দিল্লিতে মুসলমান পুলিশ সদস্যদের সংখ্যা কমানো উচিত, কারণ হিন্দু জনগণ তাদের উপস্থিতিতে নিরাপদ বোধ করছে না। তিনি হিন্দুদের আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র দেওয়ার এবং মুসলমান অস্ত্র ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স বাতিল করার অনুরোধও করেন। রাজেন্দ্র প্রসাদের মতো একজন প্রবীণ নেতাকে ‘না’ বলা কঠিন ছিল। কিন্তু সর্দার প্যাটেল উত্তর দেন যে, মুসলমান পুলিশরা স্থায়ী কর্মচারী, এবং যতক্ষণ না তারা নিজেরা পাকিস্তানে যেতে চান, তাদের বরখাস্ত করা যাবে না। অস্ত্র বিতরণের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা নিশ্চিত নই যে এই অস্ত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হবে না।”
সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল মোরার্জি দেশাই ও চৌধুরী চরন সিং- এর সঙ্গে
প্যাটেলের বিশ্বাস ছিল, হিন্দু ও মুসলমানদের আলাদা করে নয়, একসঙ্গে বসবাস ও একে অপরের সেবা করার মধ্য দিয়েই ভারত এগোতে পারে। এ ধারণা মহাত্মা গান্ধীর শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, যিনি আনিস কিদোয়িকে বলেছিলেন তাঁর স্বামীকে হিন্দু দাঙ্গাবাজরা হত্যা করার পরও হিন্দু শরণার্থীদের সাহায্য করতে, কারণ গান্ধীজির মতে, কেবল পারস্পরিক মেলামেশা ও সহমর্মিতার মাধ্যমেই সাম্প্রদায়িকতা পরাস্ত করা সম্ভব। মুসলমানদের ঘেটোয়াইজেশন শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের জন্যই সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা সর্দার প্যাটেল ১৯৪৭ সালেই উপলব্ধি করেছিলেন। তখন অনেকেই তাঁর চিন্তাকে ‘মুসলমান-বিরোধী’ বলে অভিহিত করেছিল।
কিন্তু ১৯৪৯ সালে হায়দরাবাদে তিনি বলেন, “মুসলমানরা বিদেশি নয়। তারা আমাদেরই অংশ। গান্ধীজি সবসময় বলতেন, যদি আমরা প্রকৃত স্বরাজ চাই, তবে আমাদের অচ্ছুতপ্রথা দূর করতে হবে; হিন্দু-মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে… আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে, আমরা নিশ্চিত করেছি যে মুসলমানরা সমান নাগরিক হিসেবে তাদের সমস্ত অধিকার ভোগ করবে।”