‘আওয়াজ-দ্য ভয়েস অসম ’-এর সঙ্গে এক বার্তালাপে উদ্যোমী যুবক রুলেন হাজরিকা বলেন, “আমার বাবা একজন মৎস্যচাষী। ছোট থেকেই বাবাকে কাজে সাহায্য করে আসছি। আমি প্রায়ই দেখতাম, আমাদের পুকুরে অনেক শামুক রয়েছে যেগুলো আমরা সাধারণত চুন শামুক বলে ডাকি। বাবা এগুলোকে আবর্জনা বলে ফেলে দিতেন বা মাছকে খেতে দিতেন। কারণ মানুষ তখনও শামুকের ব্যবহার এবং লাভক্ষতির ব্যাপারে সচেতন ছিলেন না। এভাবেই সময় কেটে যাচ্ছিল। ২০১৭ সালের কথা, একদিন ইন্টারনেটে ব্রাউজ করতে করতে আমি মুক্তো চাষের একটি ভিডিও দেখলাম। সেখানে আমাদের পুকুরে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া শামুক থেকে মুক্তো উৎপাদন হচ্ছে। ওটাই ছিল আমার জীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট। সেখানেই আমি খোঁজা শুরু করলাম কোথায় এর প্রশিক্ষণ নেওয়া যায়। পরে আমি ভুবনেশ্বরের সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ ফ্রেশওয়াটার অ্যাকোয়াকালচার (CIFA)-এ গিয়ে মুক্তো চাষের প্রশিক্ষণ নিলাম। ২০১৮ সালে প্রশিক্ষণ নিয়ে অসমে ফিরে এসে ঘরের পুকুরেই মুক্তো চাষের কাজ শুরু করলাম।”
পুকুরে মুক্তা চাষে যুবকদের প্রশিক্ষণ
অসম তথা সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে মুক্তো চাষ শুরু করেছিলেন প্রথমবারের মতো রুলেন হাজরিকা। মাত্র ৬০ হাজার টাকায় তিনি এই অভিনব উদ্যোগ শুরু করেছিলেন। প্রথম বছরেই তিনি ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মুক্তো এবং অলঙ্কার বিক্রি করতে সক্ষম হন।
রুলেন বলেন, “অসম তথা উত্তর-পূর্বে প্রথমবারের মতো শুরু করা আমার এই নতুন উদ্যোগ দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অরুণাচল, মিজোরাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্য থেকে বহু আগ্রহী মানুষ আমার কাছে এসে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজস্বভাবে এই চাষ শুরু করেছেন। ক্রমশ প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় ২০২৩ সালে আমি ‘অসম পার্ল ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ নামে একটি সমবায় সমিতি গড়ি। এই সমিতির অধীনে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭ হাজারেরও বেশি প্রশিক্ষণার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এর মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা অনেক বেশি। কারণ মুক্তো চাষ অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে করতে হয় এবং এর জন্য ধৈর্যের প্রয়োজন, যা মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এ পর্যন্ত প্রায় ৪ হাজারেরও বেশি মহিলাকে আমরা প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং অনেকেই এই উদ্যোগের মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হয়েছেন।”
রুলেন হাজারিকা শামুক থেকে মুক্তো সংগ্রহ করার একটি দৃশ্য
মুক্তো চাষ এক অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। এতে কৃষকরা কখনও ক্ষতির সম্মুখীন হন না। তবে সংরোপণ ছাড়া মুক্তো উৎপাদন সম্ভব নয়। একটি শামুক থেকে পূর্ণাঙ্গ মুক্তো পেতে হলে তার শরীরে অবশ্যই ‘ফরেন বডি’ সংরোপণ করতে হয়।
এই প্রসঙ্গে রুলেন ব্যাখ্যা করে বলেন, “আমরা তিন ধরনের মুক্তো উৎপাদন করি, ইমেজ পার্ল (ছবিযুক্ত মুক্তো), ঘূর্ণন মুক্তো এবং ন্যুক্লিয়াস ইনসার্শন পদ্ধতিতে তৈরি মুক্তো। একটি শামুক থেকে সর্বাধিক ২টি মুক্তো পাওয়া যায়। একটি পূর্ণাঙ্গ মুক্তো তৈরি হতে নির্দিষ্ট সময় লাগে। ইমেজ পার্ল পেতে ১৫-১৮ মাস, ঘূর্ণন মুক্তোর জন্য ২০-২৪ মাস এবং ন্যুক্লিয়াস পদ্ধতিতে ২০-৩৬ মাস সময় লাগে। মুক্তো ইন্টিগ্রেটেড ফার্মিং (মাছের সঙ্গে পুকুরে) এবং ইনডোর ফার্মিং, দুইভাবেই করা যায়। তবে মাছের সঙ্গে পুকুরে করলে কৃষকরা বেশি লাভবান হন। কারণ শামুক থাকা পুকুরের মাছ রাসায়নমুক্ত হয়, যা বাজারে বেশি চাহিদাসম্পন্ন। কারণ চুন শামুক থাকা পুকুরে কোনো রাসায়নিক ব্যবহার করা যায় না, করলে শামুক মরে যায়। উপরন্তু এই শামুক মাছের পেটেই জন্মায়, তাই আলাদা করে যোগান দিতে হয় না। মাছের শরীরে জন্মানো শামুকের মধ্যে বৈজ্ঞানিকভাবে ফরেন বডি সংরোপণ করে আমরা মুক্তো উৎপাদন করছি।”
শামুক থেকে মুক্তো সংগ্রহ করে দেখানোর একটি দৃশ্য
মুক্তো শুধু সমুদ্রেই পাওয়া যায়, এটাই অনেকের ধারণা। কিন্তু উদ্যোমী যুবক রুলেন সেই ভুল ধারণা ভেঙে দিয়েছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন মুক্তো সমুদ্র বা পুকুর, দু’জায়গাতেই পাওয়া সম্ভব। এই মুক্তো থেকে তিনি বিভিন্ন অলঙ্কার, শামুকের খোল থেকে গৃহসজ্জার সামগ্রী এবং দেওয়াল সজ্জার জিনিস তৈরি করছেন।
রুলেন বলেন, “মুক্তো শুধু সমুদ্রেই পাওয়া যায়, পুকুরে পাওয়া যায় না, এটা মানুষের মনে বড় ভুল ধারণা। কিন্তু মুক্তো সমুদ্র বা পুকুর, দু’জায়গাতেই পাওয়া যায়। অন্যদিকে মানুষের মনে হায়দ্রাবাদের মুক্তো নিয়ে একটা ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে যে, সেখানকার মুক্তোই আসল মুক্তো (রিয়েল পার্ল)। কারণ সেখানকার মুক্তো একসময় ক্ষয় হয়ে যায়। কিন্তু এটা একেবারেই সত্যি নয়। আসলে ওখানে মুক্তোর ব্যবসা রয়েছে, মুক্তো চাষ নয়। অসমে উৎপাদিত মুক্তোকে ফ্রেশওয়াটার পার্ল বলা হয়। এগুলো নষ্ট হয় না, দীর্ঘদিন অক্ষুণ্ণ থাকে। কিন্তু সমুদ্রের মুক্তোকে সল্টওয়াটার পার্ল বলা হয়, যেগুলোতে লবণের আস্তরণ থাকায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয় হয়।অসমে উৎপাদিত ফ্রেশওয়াটার মুক্তোর উচ্চ গুণমানের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।”
মুক্তো চাষের প্রশিক্ষণ নেওয়া একদল তরুণীর দল
শীতকালে করা মুক্তো চাষ খুবই কম সময়ে করা সম্ভব এমন চাষগুলির মধ্যে অন্যতম। অসম তথা উত্তর-পূর্ব ভারতের জলবায়ু মুক্তো চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে করা মুক্তো চাষে একটি শামুক থেকে মাত্র ২টি মুক্তো পাওয়া যায়।
রুলেন বলেন, “অসম এমন এক জায়গা যা খাল-বিল সমৃদ্ধ এবং এখানে গরম-ঠান্ডা দুই ঋতুই পাওয়া যায়, যা মুক্তো চাষের জন্য জরুরি। কারণ মুক্তো উৎপাদনের জন্য শামুকের শরীরে সূক্ষ্ম অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ফরেন বডি প্রবেশ করাতে হয়। এই অস্ত্রোপচারের জন্য ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উপযুক্ত। না হলে শামুক মারা যেতে পারে। শীতকালে অস্ত্রোপচার করে শামুকের শরীরে সংরোপিত ফরেন বডি গরমকালে মুক্তোতে রূপ নেয়।”
একটি প্রদর্শনীতে রুলেন হাজারিকার মুক্তোর গয়নার দোকান
অধ্যবসায়, জ্ঞান এবং উদ্যম থাকলে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ পুকুর থেকেও অমূল্য সম্পদ উৎপাদন সম্ভব। আজকের দিনে অসমে মুক্তো চাষ শুধু লাভজনক ব্যবসাই নয়, এটি গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন, মহিলাদের স্বনির্ভরতার পথ এবং পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
রুলেন বলেন, “মুক্তো চাষ করে যে কেউ আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হতে পারেন। কারণ এই চাষে সময়ের তেমন প্রয়োজন হয় না। মুক্তো চাষ করেও অন্য ব্যবসা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব। বর্তমানে আমরা অসমের ১৪টি জেলায় কাজ করছি। আমরা গড়ে তোলা গোষ্ঠীগুলিকে মুক্তো উৎপাদনের সরঞ্জাম সরবরাহ করছি এবং তাদের কাছ থেকে যথাযথ দামে মুক্তো কিনছি। পরে সেই মুক্তো বাজারে বিক্রি করছি। সম্প্রতি আমরা আসামের বিভিন্ন বাজারের পাশাপাশি বিদেশে, বিশেষ করে দুবাই ও ভুটানে আমাদের কৃষকদের উৎপাদিত মুক্তো রপ্তানি করার পরিকল্পনা করছি।”