অসম থেকে লন্ডন পর্যন্ত হাফিজ ইলিয়াস হুসেইন আনসারির অধ্যবসায়ের যাত্রা

Story by  Imtiaz Ahmed | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 7 d ago
হাফিজ ইলিয়াস হুসেইন আনসারি
হাফিজ ইলিয়াস হুসেইন আনসারি

ইমতিয়াজ আহমেদ , গুয়াহাটিঃ

মাদ্রাসা শিক্ষায় উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ সম্ভব নয়—এইরকম একটি ভুল ধারণা আজও সমাজে বিরাজমান। সেই ভ্রান্ত ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে এক মাদ্রাসা ছাত্র নিজের অধ্যবসায়ে শুধু উচ্চশিক্ষা অর্জনই করেননি, বরং নিজের স্বপ্নের চাকরিও লাভ করেছেন। সংবাদমাধ্যমে শিরোনাম দখল এই বিরল সাফল্যের গল্প। সেই তরুণ হলেন বঙাইগাঁও জেলার চাকলা গ্রামের ইলিয়াস হুসেইন আনসারি। সম্প্রতি তিনি লন্ডনে একটি আইনি প্রতিষ্ঠানে প্যারালিগাল অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।ইলিয়াস হুসেইন আনসারি একটি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পরিবারের সন্তান। পাশের বজালী জেলার একটি ছোট মাদ্রাসা থেকে শিক্ষা জীবন শুরু করে প্রথমে *হিফজ* (হাফিজ) কোর্স সম্পন্ন করেন এবং পরে "মাওলানা" কোর্সও সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি হোজাইয়ের আজমল ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে আধুনিক শিক্ষালাভ করেন।
 

 
হাফিজ ইলিয়াস হুসেইন আনসারি
 
পরে গুয়াহাটির পাশেই অবস্থিত মেঘালয়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (USTM) থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। মেধাবী এই ছাত্র প্রায় প্রতিটি পরীক্ষায়ই অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছেন।

কিন্তু আনসারির উচ্চশিক্ষার সাধনা এখানেই শেষ হয়নি। তিনি তার স্বপ্নের শহর লন্ডনে আইনি সেবা প্রদানের সম্ভাবনা অনুসন্ধান করতে থাকেন। কিন্তু ছাত্রজীবনে পড়াশোনার খরচ চালানো ছিল তার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।এই কারণে ছাত্র অবস্থায় প্রতি বছর রমজান মাসে গৌহাটির কাছের রঙিয়া স্টেশন মসজিদে তারাবির নামাজের ইমামতি করতেন। সেই নামাজ পড়ানোর বিনিময়ে তিনি কিছু অর্থ পেতেন, যা দিয়ে নিজের পড়ার খরচ চালাতেন
 
 
সহপাঠীদের সাথে  হাফিজ ইলিয়াস হুসেইন আনসারি
 
লন্ডন থেকে আওয়াজ  দ্য ভয়েস -এর সঙ্গে অনলাইন কথোপকথনে আনসারি বলেন, "আমার বিশ্বাস, সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমার স্বপ্ন অনুসরণ করতে আমাকে সঠিক পথ দেখিয়েছেন। কারণ আমি প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর আদেশ অনুসারে কাজ করে এসেছি।"

প্রায় দুই বছর আগে আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য আনসারি লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছিলেন। এরপর থেকেই তিনি স্থানীয় মসজিদগুলোতে জুমার নামাজের (শুক্রবারের জামাত)  নেতৃত্ব দিয়ে ইমাম হিচাপে  নামাজের জন্য শিক্ষাগ্রহণ অব্যাহত রেখেছিলেন।অবশেষে, চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি, তিনি লন্ডনের Barristers & Solicitors Legal Firm এবং AA Homes & Housing Ltd. -এ প্যারালিগাল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। তার বয়সী অনেকেই যেখানে ভারতের মধ্যেই স্বপ্নের মতো বেতন কল্পনা করে, সেখানে তিনি এখন বছরে প্রায় ৩৭ লাখ ভারতীয় টাকা উপার্জন করছেন।

আনসারি বলেন,"আমার দোয়া (প্রার্থনা) কবুল হওয়ায় আমি অত্যন্ত খুশি। এখানে আমার কাজ হচ্ছে ব্যারিস্টার, আইনজীবী ও অন্যান্য জ্যেষ্ঠদের আইনি খসড়া প্রস্তুতিতে সহায়তা করা, যেখানে ইমিগ্রেশন, ভিসা ও আরও অনেক বিষয়ের কাজ অন্তর্ভুক্ত। ইংল্যান্ডে বসবাস করা মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য বেশ কঠিন, কারণ এখানে জীবনযাপনের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। আমি চেষ্টা করেছি, এখানে বসবাসের জন্য সব ধরনের প্রয়োজনীয় সুবিধা অর্জন করতে, এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহর কৃপায় আমি এখানকার স্থায়ী থাকার অনুমতিও পেয়েছি,” — হাসিমুখে বলেন ইলিয়াস হুসেইন আনসারি।
 

 
ইলিয়াস হুসেইন আনসারিকে সংবর্ধনা
 
তার প্রাথমিক মাদ্রাসা শিক্ষা কি তার স্বপ্নপূরণে কোনও বাধা সৃষ্টি করেছিল কিনা ?এই প্রশ্নের উত্তরে আনসারি বলেন,"একেবারেই না। কোথাও কোনো বাধা সৃষ্টি হয়নি, না আমার নিজের দেশে, না বিদেশে। আমি পড়াশোনার জন্য প্রায় ২০টি দেশ ভ্রমণ করেছি এবং কোথাও এমন কিছু অভিজ্ঞতা হয়নি। আমি কৃতজ্ঞ আমাদের সংবিধান রচয়িতাদের প্রতি, কারণ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯ ও ৩০ সংখ্যালঘুদের নিজস্ব পছন্দের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করেছে। লন্ডনেও দিনে পাঁচবার নামাজ পড়া, কোরআন তিলাওয়াত বা ধর্মীয় নির্দেশ পালন করতে কোনও বাধা নেই। প্রত্যেকে তার নিজস্ব বিশ্বাস অনুসরণে স্বাধীন। এই দিক থেকে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রে ভারত অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশ।”
 
উচ্চশিক্ষা অর্জনের জীবনের সংগ্রাম প্রসঙ্গে আনসারি বলেন,"আজমল ফাউন্ডেশনের অধ্যক্ষ বদরুদ্দিন আজমল সাহেব, ইউএসটিএম-এর চ্যান্সেলর মহবুবুল হক স্যার, শিক্ষাবিদ বাহারুল ইসলাম স্যার সহ অনেকের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আরও অনেকের নাম নিতে পারছি না, কারণ তাঁরা চান না যে আমি তাঁদের নাম প্রকাশ করি। কিন্তু আমাকে সাহায্য করা মানুষের তালিকাটা অনেক দীর্ঘ। তাঁদের নিঃস্বার্থ সহায়তা ছাড়া আমি আজকের এই অবস্থানে পৌঁছতে পারতাম না। তাঁদের সকলের প্রতি আমি চিরকাল কৃতজ্ঞ।

এছাড়াও, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এবং ড. এ পি জে আবদুল কালামের মতো মহান ব্যক্তিত্বদের দর্শনে আমি বিশ্বাস করি— কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সবকিছু অর্জন সম্ভব, আর সেটাই আমাকে অনেক সহায়তা করেছে।”তবে এখানেই আনসারির স্বপ্ন শেষ নয়। তার সামনে আরও বড় লক্ষ্য আছে— সেই মানুষদের জন্য কিছু করা, যাঁদের মাঝে তিনি বড় হয়েছেন।তিনি বলেন,"সবাই আমাকে একটা প্রশ্ন করে— আপনি কি কখনও ভারত বা অসমে ফিরে যাবেন? নিশ্চিতভাবে আমি ফিরব, এবং আমি ঘরে ফিরে আমার আপন মানুষদের সেবা করার সংকল্প করেছি। আমি চাই আমাদের দেশে শিক্ষার আরও বিস্তার হোক। আমি এমন একটি শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করতে চাই, যা দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সহজলভ্য হবে। আমি চাই প্রতিটি শহর ও জেলায় কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় থাকুক। আমি নিশ্চয়ই ফিরে গিয়ে আমার অঞ্চলের মানুষের জন্য কাজ করব।”

নিজের মতো করে কঠিন স্বপ্ন পূরণের জন্য নতুন প্রজন্মকে কী পরামর্শ দিতে চান?আনসারি বলেন,"সফলের একমাত্র উপায় হল কঠোর পরিশ্রম। মহান ব্যক্তিদের জীবন ও আত্মজীবনী পড়ুন, জীবনে এগিয়ে যাওয়ার প্রচুর প্রেরণা পাবেন। জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু, ড. এ পি জে আবদুল কালামসহ বহু মহান মানুষ নিজেদের জীবনে অনেক কঠোর পরিশ্রম করেছেন এবং সফল হয়েছেন। অধ্যবসায়ের মাধ্যমে সব কিছুই সম্ভব শুধু মনোযোগ দিয়ে লেগে থাকতে হবে।”