রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নাম উচ্চারণ করা একটি দায়িত্ব, একটি অঙ্গীকার, যে আমরা তাঁর দেখানো পথে চলব। তাঁর পথ ছিল সংযমের, সংলাপের, ক্ষমার, এবং সবচেয়ে বড় কথা মানবতার। তিনি মদিনায় ইহুদি, খ্রিস্টান ও ভিন্ন ভিন্ন কওমকে এক যৌথ নাগরিকত্বের অধীনে একত্র করেছিলেন, যিনি ‘মদিনা সনদ’-এর মাধ্যমে পৃথিবীকে প্রথম এমন একটি সংবিধান দিয়েছিলেন যেখানে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বহুত্বকে উন্মুক্ত হৃদয়ে স্বাগত জানানো হয়েছিল।
প্রতীকী ছবি
আজ যারা ‘আই লভ মোহাম্মদ’ স্লোগানের নামে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন, তাঁদের কেন স্মরণ হয় না রাসূলুল্লাহর সেই সরলতা ও সহিষ্ণুতার, যা তিনি দুঃসময়ের মধ্যেও আঁকড়ে রেখেছিলেন? কারও নাম ধরে রাগ ঝাড়াই বা ভাঙচুর করার নামই কি ভালোবাসা? আসল ভালোবাসা তো ধৈর্য চায়, বোধশক্তি চায় এবং সর্বাধিক সত্যনিষ্ঠতার দাবি রাখে।
যদি সত্যিই হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা থাকে, তবে সেই ভালোবাসার প্রথম প্রমাণ হওয়া উচিত, আমরা তাঁর শান্তি ও সৌহার্দ্যের সেই বাণীকে গ্রহণ করি, যা আজ ‘মক্কা চার্টার’ হিসেবে বিশ্বের সামনে রয়েছে।
মক্কা চার্টার কেবল একটি দলিল নয়, এটি একটি নৈতিক সংবিধান, একটি মানবিক অঙ্গীকার— যা ১৩৯টি দেশের ইসলামী নেতৃবৃন্দ ও ১,৩০০-র বেশি মুসলিম আলেম মিলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ২০১৯ সালের মে মাসে মক্কার পবিত্র ভূমিতে মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগ আয়োজিত সম্মেলনে এটি প্রস্তাবিত হয়। এর ভিত্তিই ছিল এই চিন্তা, ইসলামের আসল চেহারা উদারতা, সহিষ্ণুতা ও মানবতা।
এই চার্টারের উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীকে উগ্রবাদ, সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও ইসলামোফোবিয়ার মতো ব্যাধি থেকে মুক্ত করা। এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, কোনো ধর্ম, জাতি বা বর্ণ অপরটির থেকে শ্রেষ্ঠ নয়। আল্লাহর দৃষ্টিতে সব মানুষ সমান, আর ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয় কেবল নৈতিকতা ও আচরণ দ্বারা, নাম বা পরিচয়ে নয়।
মক্কা চার্টার বলে, ধর্মের উদ্দেশ্য সংঘর্ষ নয়, সহযোগিতা। বৈচিত্র্য সংঘাতের কারণ নয়, বরং সংলাপের মাধ্যম। এতে বলা হয়েছে, কোনো ধর্মকে তার অনুসারীদের ভুল দ্বারা বিচার করা উচিত নয়। কোনো মুসলমানের অধিকার নেই যে তিনি রাগ বা আবেগে ইসলামের নামে হিংসা বা ঘৃণা ছড়াবেন।
‘আই লভ মোহাম্মদ’ বলার মানে এই নয় যে আমরা অন্যদের সঙ্গে লড়াই করব; বরং এটাই বোঝায় যে আমরা তাঁর মতো হওয়ার চেষ্টা করব, ক্ষমাশীল, প্রতিটি ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে ন্যায়পরায়ণ এবং হৃদয় দিয়ে ভালোবাসার মানুষ। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁদেরও ক্ষমা করেছিলেন যারা তাঁকে পাথর ছুড়েছিল। তবে আজ আমরা কেন তাঁর নামে কাউকে অপমান করব? আজ কেউ যদি হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর নামে রাস্তায় নেমে ঘৃণা ছড়ান, তবে তিনি শুধু দেশের আইনকেই উপেক্ষা করেন না, বরং রাসূলুল্লাহর শিক্ষাকেও অসম্মান করেন।
প্রতীকী ছবি
ভারতের সংবিধান সকলকে ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে কেউ নিজের ধর্মের নামে অশান্তি সৃষ্টি করবেন বা অন্যদের অধিকার লঙ্ঘন করবেন। ভালোবাসার নামে ঘৃণা ছড়ানো, ইসলাম এবং রাসূলুল্লাহ উভয়ের বিরুদ্ধেই সবচেয়ে বড় অপরাধ।
মক্কা চার্টার আজকের পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত জরুরি পথপ্রদর্শন। এটি দেখায় কিভাবে ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো রাজনৈতিক স্বার্থের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এবং কিভাবে সেগুলোকে সঠিক পথে আনতে ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধকে আবার জাগ্রত করতে হবে।
এই চার্টার ঘোষণা করে, সব দেশকে পরিবেশ রক্ষা করতে হবে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একজোট হতে হবে, নারী ও শিশুদের সম্মান ও অধিকার দিতে হবে এবং ধর্মীয় স্থানের পবিত্রতা বজায় রাখতে হবে। এই চার্টারের মাধ্যমে মুসলমানদের উপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, কেবল উপদেশ নয়, বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে হবে, উগ্রবাদের মোকাবিলা করতে হবে এবং ইসলামের সেই রূপকে সামনে আনতে হবে, যা শান্তি, প্রেম ও করুণার উপর ভিত্তি করে।
আজ যারা হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর নামে রাস্তায় ভিড় করছে, তাঁদের উচিত মক্কা চার্টার পড়া, বোঝা এবং জীবনে প্রয়োগ করা। তাঁদের বোঝা উচিত, রাসূলুল্লাহর নাম শুধু স্লোগানে নয়, আমাদের আচরণে ফুটে উঠতে হবে। আজ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব এটাই যে তাঁরা তাঁদের প্রিয় নবীর শিক্ষাকে নিজের জীবনে প্রতিফলিত করবেন, যাতে দুনিয়া নিজে থেকে বলবে, “সত্যিই, এরা মোহাম্মদের উম্মতি।”
এই চার্টারে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা যেন অরাজকতায় না গড়ায়, ধর্মীয় স্বাধীনতার মানে এই নয় যে কেউ কোনও পবিত্র বিষয়কে অপমান করবে বা অন্যের অনুভূতিকে আঘাত করবে। এটি প্রতিটি ধর্ম, প্রতিটি জাতি, প্রতিটি সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষার পক্ষে কথা বলে।
মক্কা চার্টার এক বিশ্বজনীন বার্তা, মানবতা সর্বোচ্চ এবং ইসলাম তার সবচেয়ে বড় সমর্থক শক্তি। এই দলিল কেবল মুসলমানদের নয়, বরং সমগ্র মানবজাতিকে এমন এক পথে হাঁটার দাওয়াত দেয় যেখানে আছে সংলাপ, বোঝাপড়া এবং সবচেয়ে বেশি হৃদয়কে যুক্ত করার মতো ভালোবাসা।
প্রতীকী ছবি
যদি “আই লভ মোহাম্মদ” বলতে চান, তবে সেই ভালোবাসা প্রকাশ করতে হবে তাঁর চরিত্রকে গ্রহণ করার মধ্যে, গরিবের সহায়তায়, প্রতিবেশীর খেয়াল রাখায়, শিশুদের স্নেহে, নারীদের সম্মানে এবং প্রতিটি ধর্মাবলম্বীর সঙ্গে ন্যায়ের আচরণে। এটাই আসল সুন্নত।
রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের পাঠিয়েছেন লড়াই করার জন্য নয়, মানুষকে যুক্ত করার জন্য। কুরআনের মাধ্যমে তিনি বারবার ন্যায়, সত্য, ধৈর্য ও করুণার বার্তা দিয়েছেন। যদি আমরা এসব মূল্যবোধকে জীবনে না আনি, তবে তাঁর নাম ব্যবহার করার অধিকারও আমাদের নেই।
আজকের পৃথিবীতে যেখানে ধর্মীয় পরিচয় রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠছে, মক্কা চার্টার যেন এক আলোর প্রদীপ, যা শুধু মুসলমানদের নয়, সমগ্র মানবজাতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়— যদি আমাদের ইচ্ছা, কর্ম ও ভালোবাসা সত্য হয়, তবে আমরা ঘৃণার জবাব ভালোবাসা দিয়ে দেব, হিংসার জবাব ধৈর্য দিয়ে দেব, মিথ্যার জবাব সত্য দিয়ে দেব।
তাহলে, পরের বার যখন আপনি ‘আই লভ মোহাম্মদ’ বলবেন, নিজের হৃদয়ে হাত রেখে ভাবুন, আমি কি সত্যিই মোহাম্মদ (সা.)-এর পথে হাঁটছি? আমার ভালোবাসায় কি তাঁর শিক্ষার আলো আছে? আমার ভালোবাসা কি মানবতার জন্য স্বস্তি হয়ে উঠছে, নাকি কারও জন্য কষ্ট?
যদি উত্তর হ্যাঁ হয়, তবে এ ভালোবাসা সত্যি এবং এর প্রতিধ্বনি গোটা পৃথিবী শুনবে।
“তিনি সেই মোহাম্মদ, যাঁর প্রতি ভালোবাসা তলোয়ারে নয়, শিক্ষার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।”
(লেখক আওয়াজ দ্য ভয়েস হিন্দির সম্পাদক)