শ্রীরামপুর রাজবাড়ির দুর্গাপুজো : ঐতিহ্য ও উৎসবের মেলবন্ধন

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 15 h ago
হুগলী শ্রীরামপুরের গোস্বামী রাজবাড়ির দুর্গোৎসব ও মায়ের প্রতিমা
হুগলী শ্রীরামপুরের গোস্বামী রাজবাড়ির দুর্গোৎসব ও মায়ের প্রতিমা
 
শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ 

হুগলী জেলার শ্রীরামপুরে অবস্থিত গোস্বামী রাজবাড়িতে প্রতি বছরই দুর্লভ ঐতিহ্যের ছোঁয়া নিয়ে আসেন হাজারো ভক্ত ও দর্শক। ২০২৫-এ এ দুর্গাপুজো নির্ধারিত তারিখে শুরু হয়েছে রাজপরিবারের সদস্য ও স্থানীয় সমাজের যৌথ উদ্যোগে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় পুজো আযোজিত হচ্ছে ঠাকুরদালানে, যেখানে দেবীর মূর্তি ভাস্কর্যশিল্পীদের হাতে একচালার রীতিতে তৈরি।
 
এই বছর পুজো শুরুর দিন থেকে প্রতিটি সন্ধ্যায় শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ভক্তিমূলক গান ও ভজন উপস্থাপনা করে চলেছেন শিল্পীরা। 
 
হুগলী শ্রীরামপুরের গোস্বামী রাজবাড়ির একটি ছবি (ফাইল)
 
প্রতিবছরের মতো এবারও পুরনো রীতিতে পিতলের ১৩৮টি প্রদীপ অষ্টমীর সন্ধ্যায় জ্বালানো হয়, যা এক বিশাল আলোকময় আভা সৃষ্টির অন্যতম উদ্দেশ্য। দশমীর সকালে ঠাকুরদালানের বাইরে প্রথমে মাছ ও পান ভোগ খাওয়ার পর পরিবারের মহিলারা মাকে বরণ করেন এবং মহাসমারোহে সিঁদুর খেলা পর্ব অনুষ্ঠিত হয়।
 
এ বছরের পুজোকে ঘিরে রাজবাড়ি ও তার  পার্শ্ববর্তী এলাকা বেশ সরগরম।  জানা গেছে, জেলার প্রশাসন ও রাজবাড়ি কর্তৃপক্ষ মিলেমিশে এলাকার নিরাপত্তা ও দর্শনার্থীদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার ব্যাপারে বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছেন।
 
প্রসঙ্গত, শ্রীরামপুর রাজবাড়ি (গোস্বামী বাড়ি)–এর ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। গোস্বামী পরিবার এখানকার প্রধান জমিদারি পরিবার ছিলেন, যারা ১৮শ শতাব্দীর দিকে রাজবাড়ি প্রাসাদ নির্মাণ করেন। 
 
ড্যানিশ শাসনকালে শ্রীরামপুর “ফ্রেডেরিকনগর” নামে পরিচিত ছিল, এবং গোস্বামী পরিবার স্থানীয় উন্নয়ন ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। 
 
রাজবাড়িতে আয়োজিত দুর্গাপুজোর একটি মুহূর্ত
 
রাজবাড়ির পুজোর সূচনা করেন রামগোবিন্দ গোস্বামী বা তাঁর উত্তরসূরীরা; বলা হয়ে থাকে, হরিনারায়ণ গোস্বামীর আমল থেকেই পুজো একটি ধারাবাহিক প্রচলিত রূপ লাভ করে। 
 
প্রচলিত মতে, ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই পুজোর রূপায়ন শুরু হয়েছিল।  কয়েকটি সূত্রে বলা হয়েছে, ৩৫০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে এ দুর্গাপুজো পালিত হয়ে আসছে। 
 
রোগ-ভোগ, বাধাবিপত্তি, যুদ্ধে বা অন্যান্য সামাজিক পরিবর্তনের মাঝেও এই পুজোর গতি শ্লথ হলেও বন্ধ হয়নি। গোস্বামী পরিবার এককভাবে এবং স্থানীয় সহযোগীদের সঙ্গে মিলেমিশে  অক্ষুণ্ণভাবে এই পুজোর ধারা ধরে রেখেছে। 
 
বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি, ভোলা ময়রা, বাগবাজারের রূপচাঁদ পক্ষীর দল এই রাজবাড়ির পুজোতে বিভিন্ন সময় গান পরিবেশন করেছেন, যা পুজোর সাংস্কৃতিক দিককে এক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। 
 
হুগলী শ্রীরামপুরের গোস্বামী রাজবাড়ির অন্দরমহল (ফাইল)
 
এছাড়া, মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষচন্দ্র বসু, বিধানচন্দ্র রায় সহ বহু বিশিষ্ট বিনোদনজগত, রাজনীতি ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব এই রাজবাড়িতে পুজোর সময় এবং অন্যান্য উৎসবের সময় উপস্থিত থাকতেন বলে রাজবাড়ি সূত্রে জানা গেছে। 
 
এখানে দুর্গাপুজোর মূর্তিগুলো একচালার রীতি অনুসারে গড়া হয়, যা রাজবাড়ির পারিবারিক রীতির অংশ।  অতীতে মূর্তির পিছনে ছাপা চিত্র (চলচিত্র / চলচিত্রিকা) ব্যবহৃত হত। 
 
আজকের দিনে যদিও রাজবাড়ির পুরাতন ধ্বংসাবশেষ বেশিরভাগই মেরামতের অপেক্ষায় আছে, তথাপি পরিবারের বর্তমান সদস্যরা, স্থানীয় সমাজ ও ইতিহাসপ্রেমীরা সর্বশক্তি দিয়ে ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে সচেষ্ট।