শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ
শারদীয় দুর্গোৎসব মানেই বাঙালির আধ্যাত্মিক আবেগ, ধর্মীয় আচার এবং সামাজিক মিলনমেলা। কিন্তু কলকাতার প্রবর্ত্তক সঙ্ঘের দুর্গাপুজো বহন করে এক বিশেষ বার্তা ও আলাদা স্বকীয়তা। এখানে দেবী দুর্গার পরিবর্তে পূজিতা হন ভারত মাতা। জাতীয়তাবাদের আবেগকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হয়েছিল এই পূজা, যা আজও সমানভাবে অনুসৃত হচ্ছে।
প্রবর্ত্তক সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২০ সালে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজসেবা, শিক্ষা বিস্তার এবং ভারতীয় চেতনার জাগরণ। তাই এখানকার দুর্গোৎসবও কেবল ধর্মীয় আচার নয়, জাতীয় ভাবধারার প্রতীক। ষষ্ঠীর দিন বোধন ও নবপত্রিকা স্নান দিয়ে শুরু হয় পূজার আয়োজন। চার দিন ধরে চলে পুজো, প্রতিটি পর্যায়ে থাকে দেশাত্মবোধের ছাপ। মণ্ডপের কেন্দ্রে থাকে ভারত মাতার প্রতিচ্ছবি, যা দর্শনার্থীদের মনে গেঁথে দেয় ভিন্নতর অনুভূতি।
অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে, অর্থাৎ সন্ধিপুজোর সময় আয়োজিত হয় এক বিরাট হোমযজ্ঞ। দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি এবং মানুষের মঙ্গল কামনায় এই যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ে ভক্তরা একত্রিত হয়ে মন্ত্রোচ্চারণ ও অগ্নিহোমে অংশ নেন। প্রবর্ত্তক সঙ্ঘের পুজোর অন্যতম বিশেষ দিক হল নবমীর দিন দেবীর আমিষ ভোগে পূজিত হওয়া, যা বাঙালির ঐতিহ্যের একটি ব্যতিক্রমী চিত্র।
দশমীতে ঘটে ঘট বিসর্জন। মায়ের প্রতীকী প্রতিমা, অর্থাৎ ঘট বিসর্জনের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় পুজো। তবে এখানে প্রতিমা বিসর্জনের মতো বাহুল্য আয়োজন নেই; বরং থাকে সরল আচার ও শুদ্ধ ভক্তিভাব।
প্রবর্ত্তক সঙ্ঘের পুজোতে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পাঠচক্র, আলোচনা এবং দেশাত্মবোধক গানের আসর। বহু বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মী এই মণ্ডপে আসেন এবং বক্তব্য রাখেন। সঙ্ঘের তরুণ সদস্যরা সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকে আয়োজন ও পরিষেবামূলক কাজে।
প্রতিবছর অসংখ্য ভক্ত ও দর্শনার্থী এই পুজো দেখতে আসেন। অনেকে বলেন, এই পূজার আচার অনুষ্ঠান দেখে যেন স্বাধীনতা আন্দোলনের চেতনা আবারও জীবন্ত হয়ে ওঠে। ভারত মাতার পূজার মধ্য দিয়ে প্রবর্ত্তক সঙ্ঘ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ধর্মীয় পূজা কেবল ভক্তির মাধ্যম নয়, সমাজসেবার অঙ্গ এবং দেশপ্রেম জাগানোর শক্তিশালী উপায়ও হতে পারে।
প্রবর্ত্তক সঙ্ঘ অনুগামী অরুণ ভট্টাচার্য জানান, 'আমরা দুর্গা পুজোর তিন দিন দেশমাতৃকার বন্দনা করি। ভারত মাতাকেই দুর্গা পুজোর সব বিধি নিয়ম মেনে পুজো করি।' আশ্রমপুত্র বিনয় ভূষণ চৌধুরী বলেন, ' আমার জন্ম চট্টগ্রামে। আন্দোলনের আঁতু ঘর। সেখান থেকে বিপ্লব তীর্থ চন্দননগর প্রবর্তক সঙ্ঘ। আমাদের ছোটবেলা থেকেই আমরা জেনেছি আমার জন্মভূমি আমার মা। তাই জন্মভূমি মাকে আমরা দেবী রূপে পুজো করি। পুজোর এই তিন দিন ভারত মাতা কি আমরা দুর্গা রূপে এখানে পুজো করে থাকি।' একই সুর শোনা গেল আশ্রম কন্যা তপতী দেবীর কণ্ঠেও। আশ্রমিক ভাবধারায় যিনি জীবন যাপন করেন সেই তিনি পুজোর কদিন যেন শৈশবে ফিরে যান। ঘুরেফিরে বারবার প্রবর্ত্তক সঙ্ঘের দুর্গাপুজোর তাঁর স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকেন তিনি। সঙ্ঘের আরেক সদস্যা গোপাদেবীও বলেন যে পুজোর কদিন তারা আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়েই কাটিয়ে দেন। দুর্গাপুজোর পঞ্চমী থেকে শুরু করে লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত টানা চলে এই আনন্দ উৎসব।
আজ যখন দুর্গাপুজো ক্রমশ আড়ম্বর, আলো ও শিল্পসজ্জার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠছে, তখন প্রবর্ত্তক সঙ্ঘের এই সরল অথচ গভীর বার্তাবাহী পূজা আমাদের মনে করিয়ে দেয় প্রকৃত উৎসবের তাৎপর্য। দেশপ্রেম ও মানবসেবার চেতনাই এখানে দুর্গোৎসবের মূল মন্ত্র।