অপর্ণা দাস / গুয়াহাটি
ভারত এক উৎসবমুখর দেশ, এখানে প্রতিটি ঋতু, প্রতিটি ক্যালেন্ডারের মাস যেন এক নতুন আনন্দের আবহ নিয়ে আসে, যার প্রতিটি উৎসবের গল্পে লুকিয়ে থাকে জীবনের শিক্ষা। পৌরাণিক কাহিনির সেই বার্তাগুলো আজও আমাদের পথপ্রদর্শক, যা মানুষকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং মানবিকতার মূল্যবোধকে জাগ্রত করে। এমনই একটি বিখ্যাত উৎসব হল বাঙালির প্রিয় শরৎকালের দুর্গোৎসব। যার সমাপ্তি ঘটে বিজয়া দশম এর মধ্যে দিয়ে। একই দিনে ভারতের বহু প্রান্তে পালিত হয় দশেরা বা বিজয়াদশমী।
আজ বিজয়া দশমী। তবে আজকের দিনটি আরও বিশেষ, কারণ আজ ২রা অক্টোবর আজই মহাত্মা গান্ধীর জন্মজয়ন্তী এবং লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর জন্মজয়ন্তীও পালিত হচ্ছে। এই দিনগুলো মানবতার শিক্ষা ও জীবনের আদর্শ মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এবার মূল কথায় আসা যাক, তা হল বাংলার বিজয়া দশমী আর উত্তর ভারতের দশেরার মধ্যে পার্থক্য যেমন রয়েছে, তেমনই মিলও রয়েছে এক গভীর মানবতাবোধে।
বিজয়া দশমীর মুহূর্তে অনুষ্ঠিত দর্পণ বিসর্জন ও সিঁদুর খেলা (ফাইল)
বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপুজো শুরু হয় মহালয়ার মধ্য দিয়ে। ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত দেবী দুর্গারপুজো চলে এক উচ্ছ্বাসময় সামাজিক আবহে। এই বিজয়া দশমীর আনন্দের একটি বিশেষ আকর্ষণ হল সিঁদুর খেলা, যেখানে সধবার নারীরা একে অপরকে সিঁদুরে রাঙিয়ে কোলাকুলি করে আনন্দ ও সৌহার্দ প্রকাশ করে। এরপরই আসে মায়ের বিদায়ের পালা, যেখানে আবেগে ও চোখের জলে ভাসিয়ে মাকে বিদায় জানানো হয়। এই দিনে দর্পণ বিসর্জন অনুষ্ঠিত হয়, দেবী দুর্গার বিসর্জন এখানে প্রতীকীভাবে বোঝায়, মঙ্গলশক্তির সংসারে পুনঃপ্রবেশ এবং অশুভ শক্তির বিনাশ। বিসর্জনের পর বাঙালিরা একে অপরকে শুভেচ্ছা জানায়, মিষ্টি মুখ করায়, আলিঙ্গন করে “শুভ বিজয়া” বলে। এই রীতি ভ্রাতৃত্ব, ঐক্য আর সৌহার্দ্যের প্রতীক।
অন্যদিকে, উত্তর ভারতের দশেরা মূলত রামায়ণকথার সঙ্গে যুক্ত। অযোধ্যার রাজপুত্র রাম এই দিনেই লঙ্কাধীশ রাবণকে বধ করেন। সেই থেকে এই দিনকে “সত্যের জয়” ও “অন্যায়ের পরাজয়”-এর প্রতীক হিসাবে দেখা হয়। আজও সেই ঐতিহ্য ধরে রাখা হয়েছে, বিশালাকৃতির রাবণ, মেঘনাদ ও কুম্ভকর্ণের প্রতিমূর্তি তৈরি করে তা আগুনে দহন করা হয়। যদিও দশেরার মূল থিম হলো রাবণের দহন, তবে ভারতের কিছু স্থানে যেমন দিল্লি-এনসিআর, গাজিয়াবাদ, কোটা এবং অন্যান্য শহরে রাবণের সঙ্গে মেঘনাদ ও কুম্ভকর্ণের প্রতিমূর্তিকেও দাহ করা হয়। এই আচার আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অহংকার, লোভ আর দুষ্টতা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তার পতন অবশ্যম্ভাবী।
দশেরা উপলক্ষে রাবণ মেঘনাথ ও কুম্ভকর্ণের প্রতি মূর্তি দহনের একটি দৃশ্য (ফাইল)
সুতরাং বলা যায় দুটি উৎসবের বহিঃপ্রকাশ ভিন্ন হলেও তাদের অন্তর্নিহিত বাণী অভিন্ন। বাংলার বিজয়া দশমী যেমন দেবী দুর্গার শুভ শক্তির বিজয়কে স্মরণ করায়, তেমনি দশেরা মনে করায় রামের ধর্মযুদ্ধের সাফল্য। একদিকে মাতৃশক্তির জয়, অন্যদিকে ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রামের বিজয়। দুটোই মানবজাতিকে শেখায়,অসুরের বিরুদ্ধে সুসুর, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়, অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর লড়াই অনন্তকাল চলতে থাকে।
এই উৎসব কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, মানবতার শিক্ষা। বিজয়া দশমী ও দশেরা আমাদের শেখায়:
* মানুষের অন্তরের লোভ, অহংকার, হিংসা ও হিংস্রতাকে দমন করতে হবে।
* সমাজে সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
*অন্যায়ের কাছে আপস না করে সত্য ও ন্যায়কে ধরে রাখতে হবে।
আমার উপলব্ধি অনুযায়ী, বিজয়া দশমী কিংবা দশেরা; এ কেবল আনন্দ বা আচার নয়, এটি মানুষের আত্মশুদ্ধির দিন। যদি আমরা এই উৎসবের আসল মর্ম উপলব্ধি করতে পারি, তবে শুধু প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখাই নয়, প্রতিদিনের জীবনে সত্য, ন্যায় ও মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোই হবে আসল পুজো।
মায়ের বিদায় বেলার শেষ মুহূর্তে (ফাইল)
তাই বলার অপেক্ষা রাখে না, বিজয়া দশমী ও দশেরা, দুটো ভিন্ন আঞ্চলিক আবহ থেকে উঠে আসলেও, তাদের একটাই বার্তা; “অসুর শক্তির বিনাশ অবধারিত, সুসুর শক্তিই চিরস্থায়ী।” মহাভারতের শ্লোকেও রয়েছে "ধর্ম রক্ষতি রক্ষিতঃ"- যা আমাদের শেখায়, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ আচরণই পর্যন্ত অশুভ শক্তির উপর বিজয় এনে দেয়।
আজকের জটিল বিশ্বে এই শিক্ষা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। নৈতিকতা, সহমর্মিতা এবং ন্যায়পরায়ণ মনোভাব আজকের প্রজন্মকে শুধু ব্যক্তিগত জীবনে নয়, সমাজ ও দেশ গঠনের ক্ষেত্রেও দৃঢ় ভিত্তি প্রদান করবে। এই শিক্ষার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষম হবে এবং একটি সুসংহত, শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ গড়ে তুলতে পারবে।