শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ / কলকাতা
হুগলির কামারপুকুরের লাহাবাড়ির পুজো শতাব্দী প্রাচীন। লাহা পরিবারের পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রামকৃষ্ণের ছোটবেলা। একদা কোন কারণে ঠাকুর রঙ করার কারিগর না আসায় ছোট্ট রামকৃষ্ণ লাহা বাড়ির মা দুর্গার চোখ এঁকে দিয়েছিলেন।
একদম ঠিক কথা। এই বাড়ির দুর্গাপুজোয় তিনি একেঁছিলেন মা দুর্গার চোখ। অবশ্য তখন তাঁর পরিচয়, শ্রী গদাধর চট্টোপাধ্যায় বা গদাই, ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের কনিষ্ঠ পুত্র। কামারপুকুরের সবথেকে পুরানো এই পুজো, শতাব্দী প্রাচীন কামারপুকুরের লাহাবাড়ির দুর্গাপূজা আজও মহাসমারোহে পালিত হয়। কামারপুকুরের লাহাবাড়ির দুর্গাপুজো চালু করেছিলেন শ্রী জগন্নাথ লাহা। সে প্রায় আনুমানিক ৪৫০ বছর আগের কথা। তারপর কালের ক্রমে পুজো চললেও বন্ধ হয়ে যায় মাঝের ২০-২৫ বছর। তারপর ২৪৩ বছর আগে সেই পুজো পুনরায় শুরু করেন, শ্রী জগন্নাথ লাহার বংশধর শ্রী ধর্মদাস লাহা। তারপর থেকে আজ অবধি মহাসমারোহে এই পুজো পালন করে আসছেন হুগলি জেলার কামারপুকুরের লাহা পরিবার, শ্রী রামকৃষ্ণের পবিত্র জন্মভূমি এই কামারপুকুরে।
মহালয়ার দিন মায়ের প্রথম দর্শন মেলে
প্রথা মেনে এই পুজোর কাঠামো পুজো শুরু হয় বিপত্তারিণী পুজোর দিন আর ঘট উত্তোলন হয় মহালয়ার পরের দিন। প্রতিপদের দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় মহাচণ্ডীর পুজো। আর এই পুজোর অন্যতম আকর্ষণ হল ৮ দিন ব্যাপী যাত্রাপালা যা চলে মহালয়ার দিন থেকে ষষ্ঠীর দিন অবধি। আগে ঠাকুরের পাঠশালাতেই হতো এই যাত্রাপালা, তবে এখন এই পাঠশালার আটচালার পাশে মঞ্চ বানিয়ে চলে যাত্রাপালা। এই লাহা বাড়ির পাঠশালাতেই স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছিলেন শ্রী রামকৃষ্ণ। পাঠশালাটি আজও এখানে আছে। যাত্রা উপলক্ষ্যে গ্রামবাসীদের ভিড় থাকে চোখে পড়ার মতো। শুধু তাই নয়, পুজোর এই কয়দিন থাকে বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
জমিজমা সংক্রান্ত আইনি বিবাদে জড়িয়ে পড়ে মামলায় হাজিরা দিতে যাচ্ছিলেন ধর্মদাস লাহা। গ্রামের মেঠোপথ ধরে মামলার শুনানিতে হাজিরা দিতে তিনি চুঁচুড়া আদালতে যাচ্ছিলেন। পথে ক্লান্ত হয়ে গাছের নীচে বিশ্রাম নেন। সেই সময়ে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে মা তাঁকে বলেন, মামলায় জয়ী হবি তুই, বাড়ি গিয়ে আমার পুজো শুরু করিস। খানাকুল থেকে দুইজন পটুয়া যাচ্ছে।
রামকৃষ্ণ দেব এই বাড়িতে বিশেষ ভাবে পূজিত হন
স্বপ্ন সত্যি হয়। মামলায় জিতে মায়ের স্বপ্নাদেশের কথা ভুলে যান ধর্মদাস। কিন্তু বাড়ি ফিরে চমকে যান তিনি। দেখেন খানাকুল থেকে দুই প্রতিমাশিল্পী হাজির। পটুয়ারা ধর্মদাসকে জানান, একটি মেয়ে এসে তাঁদের দুর্গা প্রতিমা গড়ার কথা বলে গিয়েছেন। তাই তাঁরা এসেছেন বলে জানান। সেই থেকে লাহাবাড়ির দুর্গাপুজো শুরু। তারপর সেখানে চালা করে শুরু হয় পুজো, সাল তখন ১১৮২ বঙ্গাব্দ বা ১৭৭৫ খ্রীস্টাব্দ। বর্তমানে সেখানে মায়ের মন্দির অবস্থিত। যেটি প্রতিষ্ঠা হয় ১২০২ বঙ্গাব্দে বা ১৭৯৫ খ্রীস্টাব্দে। তবে পুজো শুরু করে ধর্মদাস লাহা পড়েন মহা অস্বস্তিতে। দুর্গাপুজোয় বলি ছিল তখনকার দিনের প্রথা। আর ধর্মদাস লাহা ছিলেন গোঁসাই গুরুর শিষ্য। পরম বৈষ্ণব। বৈষ্ণব বাড়িতে শাক্ত মতে বলি হবে কিভাবে?
তাই বলি কি করে হবে এই ভেবে তিনি চললেন তাঁর গুরুর কাছে সাতবেড়িয়ার মোমিনপুরে। পথে পড়ে সাতবেড়িয়া খাল। পালকিতে করে যেতে যেতে সেখানে তিনি দেখা পান এক বৃদ্ধা রমণীর। বৃদ্ধা ধর্মদাসবাবুকে জিজ্ঞেস করেন, “বাবা তুমি কোথায় যাবে?” তখন ধর্মদাসবাবু তাঁর সব কথা খুলে বলেন, “আমি কি করে যে বলি দিই? তাই আমি গুরুর বাড়ি যাচ্ছি” তখন ঐ বৃদ্ধা বলেন, “মা কি কোনো সন্তানের রক্ত চাইতে পারে? তবে তুই যা দেখ তোর গুরু কি বলে?”
পুজো উপলক্ষে বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
তারপর ধর্মদাসবাবু কিছুটা রাস্তা যাবার পর দ্বিধাগ্রস্ত হন ও তাঁর কিছু লোককে পাঠান ওই বৃদ্ধা রমনীর সন্ধান করতে। কিন্তু কেউ তাঁর আর সন্ধান পান না। তিনি যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছেন। তারপর ধর্মদাসবাবু গুরুর বাড়ি যান ও গুরুকে সমস্ত কথা বলেন। সব শুনে গুরুদেব বলেন, "মা নিজেই তোমাকে দেখা দিয়ে বিধান দিয়ে গেছেন"। সেই থেকে লাহাবাড়ির দুর্গাপূজাতে বলিপ্রথা নিষিদ্ধ। যা আজও মহাসমোরহে পালিত হয়ে চলছে। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের লাহা বাড়ির মাতৃ প্রতিমার চক্ষু দানের ঘটনাটি সম্ভবত ১৮৪৮ থেকে ১৮৫০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে ঘটেছিল। বর্তমানে সেখানে মায়ের মন্দির অবস্থিত। যা ১২০২ বঙ্গাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
মহালয়ার পরের দিন থেকে এখানে যাত্রাপালা শুরু হয়। মঞ্চ রয়েছে। দুর্গা নাকি যাত্রা শুনতে ভালোবাসতেন। সেই রীতি মেনে এখনও বংশ পরম্পরায় যাত্রাপালার আসর বসে। মহালয়ার দিন থেকে আট দিনব্যাপী যাত্রাপালা হয়। যাত্রাশিল্পীরা বলেন, মা দুর্গার কাছে প্রথম যাত্রাপালার অনুষ্ঠান করেন। তা হলে সারা বছর তাঁদের খুব ভালো ভাবে কাটে। বর্তমানে লাহা পরিবারের সদস্য সংখ্যা প্রায় দুশো। পুজোর দিনগুলিতে সবাই মন্দিরেই প্রসাদ খান। কারো বাড়িতে রান্না হয় না। আরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এখানে কুমারী পুজো হয় নবমীর দিন। আর যিনি মা দুর্গার পুজো করেন তিনি ঘট উত্তোলনের দিন থেকে মন্দিরে থাকেন। ওই মন্দিরেই পুজো করে খান। এভাবেই চিরাচরিত প্রথা মেনে বছর বছর ধরে চলে আসছে লাহাবাড়ি দুর্গাপুজো যা আজও একই ভাবে বিদ্যমান।