অনিকা মহেশ্বরী / নয়া দিল্লি
কলকাতার দুর্গাপুজো শুধু ধর্মীয় আস্থার উৎসব নয়, বরং এক সৃজনশীল মহোৎসব। এটি দেশের অন্যান্য উৎসব থেকে সবসময়ই আলাদা। এখানে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ একসঙ্গে মিশে যায় নানা থিমে। এই পুজো শহরকে প্রতি বছরই নতুন আকারে রাঙিয়ে তোলে, কোথাও রাজনীতি, কোথাও প্রযুক্তি, আবার কোথাও মানবিকতার বার্তা নিয়ে হাজির হয় প্রতিটি মণ্ডপ।
আনন্দময় এই শহরে দুর্গা পুজোর উদযাপন প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি করে, যেখানে প্রতিটি পুজো কমিটি আগের চেয়ে আরও অনন্য, কল্পনাপ্রসূত ও দৃষ্টিনন্দন প্রদর্শন উপস্থাপন করার চেষ্টা করে। কলকাতার পুজো মণ্ডপগুলোতে কোনো বিষয়বস্তুই অতিরিক্ত অপ্রচলিত বা অসম্ভব বলে ধরা হয় না। এখানকার সৃজনশীলতাই প্রতিবার দর্শনার্থীদের বিস্মিত করে তোলে।
সুরুচি সংঘের পুজো মণ্ডপে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এবং আন্দোলনের দৃশ্যের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলীর ওপর বাংলা গ্রন্থের কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে
এই বছরের দুর্গা পুজো ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তবে ষষ্ঠীর পর থেকেই শহরের সর্বত্র মণ্ডপগুলোতে প্রচুর ভিড় দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি সত্ত্বেও মণ্ডপে মানুষের সংখ্যা কমেনি।
উল্লেখযোগ্য যে, এবারে বহু পুজো মণ্ডপের বিষয়বস্তু রাজনীতি কিংবা সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটিয়েছে। দ্য হিন্দু-র এক প্রতিবেদনের অনুযায়ী, গৃহমন্ত্রী অমিত শাহ ২৬ সেপ্টেম্বর সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের প্যান্ডেল উদ্বোধন করেন। এই মণ্ডপের বিষয়বস্তু হলো জম্মু-কাশ্মীরের পাহালগামে জঙ্গি হামলার জবাবে পরিচালিত সামরিক অভিযান "অপারেশন সিন্দুর"। প্যান্ডেলটি কাশ্মীরের পাহাড়ের মতো সাজানো হয়েছে, আর ত্রিবর্ণের নকশা খোদাই করা হয়েছে এর ছাদে।
কলকাতার সন্তোষ মিত্র ক্লাবের পুজোয় 'অপারেশন সিন্দুর' থিমের লাইট এন্ড সাউন্ড শো- এর আয়োজন করা হয়েছে
একটি তিন মিনিটের লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো-তে ‘অপারেশন সিন্দুর’ প্রদর্শন করা হচ্ছে, যেখানে ট্যাঙ্ক থেকে ধোঁয়া ও শব্দ বের হচ্ছে। শিল্পীরা জম্মু-কাশ্মীর হামলায় নিহত পশ্চিমবঙ্গের দুই পর্যটক, বিতান অধিকারী ও সমীর গুহর কাহিনীও মঞ্চস্থ করেছেন।
একইভাবে, দক্ষিণ কলকাতার সমাজ সেবী সংঘের প্যান্ডেলও একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা দিয়েছে। এর বিষয়বস্তু হলো “পথের পাঁচালী ১৯৪৬”, যা সেই বছরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহতা স্মরণ করায়। মণ্ডপটি লেক ভিউ রোডের একটি পুরোনো মহল্লার কাহিনী তুলে ধরে, যেখানে মানুষ একত্রিত হয়ে একে অপরকে সাহায্য করেছিল। এই প্যান্ডেলটি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং মানবিক ঐক্যের পক্ষে এক আবেগঘন আহ্বান।
বেহালা ফ্রেন্ডস এই বছর দুর্গাপুজোর থিম হিসেবে গাজায় চলমান মানবিক সংকট এবং ১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ কে বেছে নিয়েছে
মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের খাগড়া শ্মশানঘাট দুর্গা পুজো কমিটি ‘বিনাশ’ থিমে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এখানে মহিষাসুরকে আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রূপে দেখানো হয়েছে, যাকে ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে ধরা হয়েছে। একইভাবে, খাগড়া সাধক নরেন্দ্র স্মৃতি সংঘ মহিষাসুরের রূপে বাংলাদেশি নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনুস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে উপস্থাপন করেছে। এসব মণ্ডপ জাতীয়তাবাদী আবেগে পূর্ণ।
কিছু মণ্ডপ আবার ভারতের ঐতিহাসিক গৌরব ও প্রযুক্তিগত ভবিষ্যতের ওপর ভিত্তি করে গড়া হয়েছে। অর্জুনপুরের 'অমরা সাবাই' ক্লাব ‘মুখোমুখি’ নামের থিম বেছে নিয়েছে, যেখানে দেবী দুর্গার প্রতিমা স্টেইনলেস স্টিলের ফিউচারিস্টিক আর্চে সজ্জিত। পুরো মণ্ডপটি গতিশীল শিল্প, ঘূর্ণায়মান কাঠামো ও আধুনিক স্থাপত্যে সাজানো।
অতীত ও ভবিষ্যতের ওপর ভিত্তি করে নির্মাণ করা আর্জুনপুরের 'আমরা সবাই' ক্লাবের পুজো
উত্তর কলকাতার একটি মণ্ডপে "কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা" মুখ্য আকর্ষণ হিসেবে রাখা হয়েছে। এখানে চ্যাটজিপিটি-র তৈরি ছবি, বিশাল কিবোর্ড, ঝলমলে আলো এবং মানুষের মতো দেখতে রোবট দর্শকদের টেনে নিচ্ছে। এটি প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির এক বিস্ময়কর মেলবন্ধন।
অন্যদিকে, আরেকটি মণ্ডপে ৭০-এর দশকের সুপারহিট ছবি শোলে-কে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। আয়োজকরা শোলে-র পোস্টার, সংবাদপত্রের কাটিং এবং আর. ডি. বর্মনের সংগীতের মাধ্যমে এক জীবন্ত সিনেমাটিক অভিজ্ঞতা দিয়েছেন। তারা একক স্ক্রিন থিয়েটারের ধীরে ধীরে হারিয়ে যাওয়া এবং ওটিটির প্রভাব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
জগৎ মুখার্জি পার্কে ভবিষ্যতের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)- প্রধান বিশ্বের এক ঝলকসহ একটি পুজো মণ্ডপ নির্মাণ করা হয়েছে
চলাত বাগান লোহাপট্টির মতো মণ্ডপগুলোতে বাংলাভাষার বিকাশের বিষয়বস্তু তুলে ধরা হয়েছে। দ্য ফেডারেল-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখানে উত্তর কলকাতার ঐতিহাসিক ছবি ও জীবনযাত্রা প্রদর্শন করা হয়েছে।
এছাড়া, পল্লী ৬৬-এর মণ্ডপ 'থাইয়্যাম' থিমের ওপর ভিত্তি করে সাজানো হয়েছে। এখানে কেরালার শিল্পীরা ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশন করছেন। দেবতা ও পূর্বপুরুষদের পুজো করা 'থাইয়্যাম' থিম এই মণ্ডপকে আরও বিশেষ করে তুলেছে। এসব প্রচেষ্টার ফলে কলকাতা নিঃসন্দেহে ভারতের সৃজনশীল ও চিন্তাপ্রবণ দুর্গা পুজোর কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
৬৬ পল্লী - এর পুজো মন্ডপ
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে মহিষাসুর রূপে উপস্থাপন করা থেকে শুরু করে এআই-এর মাধ্যমে বিশ্বজনীন উদ্বেগকে তুলে ধরা, সব মিলিয়ে কলকাতা প্রমাণ করেছে, সে শুধু ঐতিহ্য রক্ষা করে না, ভবিষ্যতের দিকগুলোকেও সমান গুরুত্ব দেয়।