বন্যার অভিশাপকে আশীর্বাদে রূপান্তরিত করেছে অসমের একটি গ্রাম

Story by  Ariful Islam | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 1 Months ago
মাদৈকাটা গ্রামের আখের চাষ
মাদৈকাটা গ্রামের আখের চাষ
আরিফুল ইসলাম ,গুয়াহাটি ঃ

কৃষি বিপ্লবের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে উঠেছে অসমের একটি বিশেষ গ্রাম। প্রতিবছর বন্যা যেখানে একসময় ছিল এক অভিশাপ, সেটিকেই আশীর্বাদে রূপান্তরিত করেছে এই গ্রামের বাসিন্দারা। প্রতি বছর বন্যায় গ্রামের মানুষের কর্মসংস্থান প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ত। কিন্তু নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও এই গ্রামের উদ্যোগী কৃষকদের প্রচেষ্টায় কৃষির মাধ্যমে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে গ্রামটি।

কামরূপ গ্রামীণ জেলার রঙিয়া সীমান্তবর্তী বাকসা জেলার মাদৈকাটা গ্রামটি গত ২৫ বছর ধরে নীরবে কৃষি বিপ্লবের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই গ্রামের কৃষকরা ধানচাষের পরিবর্তে আখ চাষ করে জীবিকা নির্বাহের এক নতুন পথ খুলে দিয়েছেন। এর ফলে গ্রামটি শুধু অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর হয়নি, বরং আসামের কৃষিক্ষেত্রেও এক নতুন দিশা দেখিয়েছে।

মাদৈকাটা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পুঠিমারি নদী। বর্ষা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই নদীর প্রবল স্রোতের প্রথম প্রকোপ পড়ে মাদৈকাটা গ্রামে। ২০০০ সালে আসা এক ভয়াবহ বন্যা মাদৈকাটার কৃষিক্ষেত্রকে ব্যাপক ক্ষতি করেছিল। বন্যার সাথে আসা বালির স্তর চাষের উপযোগী উর্বর মাটি নষ্ট করে দিয়ে ধানচাষের অযোগ্য করে তোলে । পরবর্তী বছরগুলোতেও একটানা ২-৩ বার করে হওয়া বন্যায় জমিগুলোর বিভিন্ন অংশে তিন থেকে আট ফুট পর্যন্ত বালির স্তর জমে যায়।
 

 

যুব সমাজকর্মী আজিজুল হক

সোনালী শস্যে ভরা মাঠগুলো যখন বালিতে ঢেকে যায়, তখন গ্রামের কৃষকদের জীবিকা সংকটের মুখে পড়ে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জের মধ্যেও গ্রামের কয়েকজন যুবক হার না মেনে বিকল্প চাষের সন্ধান করতে থাকে। তারা পরীক্ষামূলকভাবে কয়েক বিঘা জমিতে আখ চাষ শুরু করে। প্রথম প্রচেষ্টায়ই আখ চাষে ভালো ফল হওয়ায় গ্রামের অন্য কৃষকরাও ধানের পরিবর্তে আখ চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বর্তমানে এই গ্রামের অধিকাংশ কৃষক আখের চাষ করেন।

এই কঠিন সময়ের মাঝখানে শুরু হওয়া আখ চাষের এই বিপ্লব আজ মাদৈকাটা গ্রামের চেহারাই বদলে দিয়েছে। বর্তমানে এই অঞ্চলের ১০০০-এরও বেশি কৃষক হাজার হাজার বিঘা জমিতে  আখ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।

স্থানীয় যুব সমাজকর্মী তথা কৃষক আজিজুল হক বলেন, “বন্যায় মাঠগুলো বালিতে ঢেকে যাওয়ার আগে আমাদের এখানকার কৃষকরা ধান চাষ করতেন। এখন  আখ চাষে আমাদের কৃষকরা ভালোই লাভবান হচ্ছেন।  আখ চাষের একটি বিশেষ দিক হলো প্রথম কয়েক বছরে একটু কষ্ট করতে হয়, কারণ নতুন করে গাছ লাগাতে হয়। কিন্তু পরবর্তী বছরে আগের লাগানো আখের গাছ থেকেই উৎপাদন চলতে থাকে। শুধু মাঠের ঝোপঝাড় আর বন পরিষ্কার করলেই হয়। এই প্রক্রিয়ার কারণেই অন্যান্য ফসলের তুলনায় আখ চাষে খরচ কম হয় এবং কম পরিশ্রমেই হয়ে যায়।”
 

 

 খেতে কীট নাশক প্রয়োগের সময় এক কৃষক

 
উল্লেখযোগ্য যে, রাজ্যে আখের চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। আখ রপ্তানির কথা উল্লেখ করে গ্রামের আরেক কৃষক নজরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের আখ রঙিয়া, চাংসারি, গুয়াহাটি , নলবাড়ি, গোরেশ্বর,নাগ্রিজুলি, মঙ্গলদৈসহ আশেপাশের এলাকায় রপ্তানি হয়। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভুটানেও রপ্তানি হয়। অসমের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীরা তো আসেনই, ভুটানের ব্যবসায়ীরাও আমাদের  থেকে আখ  কিনে নিয়ে যান।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা সাধারণত চৈত্র মাস থেকেই আখ চাষ শুরু করি। যদি চৈত্রে বৃষ্টি না হয়, তবে বৈশাখ মাস থেকেই শুরু করি। প্রথমে আমরা আখ গাছের আগাগুলো রোপণ করি। দুই দিন পর যখন চারা গজায়, তখন একটু একটু করে মাটি চাপা দিয়ে আমাদের ঘরোয়া সার প্রয়োগ করি। এরপর তেমন বিশেষ কাজ থাকে না, মাঝে মাঝে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করি। কার্তিক মাস (অক্টোবর নাগাদ) থেকে আমরা আখ কাটা শুরু করি।”

গ্রামটির আশেপাশের এলাকার হিন্দু গ্রামগুলোতে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় আখের জন্য এই কৃষকরাই প্রধান ভরসা। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বিভিন্ন পূজা বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত আখ এই কৃষকদের থেকেই কেনেন বলে জানান নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, “চর অঞ্চলগুলোতে যেসব আখ চাষ হয়, সেগুলোর সঙ্গে আমাদের আখের রং ও স্বাদে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আমাদের আখ গুলো বেশি মিষ্টি ও সুস্বাদু। তিনি বলেন,আমি নিজেও আগে ধান চাষ করতাম, কিন্তু এখন আখ  চাষ করে অনেক বেশি লাভবান হয়েছি। আখ  চাষে কষ্ট কম, আর লাভ বেশি।”

মাদৈকাটা গ্রামের কৃষকদের মতে, বর্তমানে প্রতি বিঘা জমি থেকে প্রায় ১ লক্ষ টাকার আয় সম্ভব হচ্ছে। এই অর্থনৈতিক সফলতাই প্রতিবছর আখ  চাষের পরিসর বাড়াতে কৃষকদের উৎসাহ দিচ্ছে। মাদৈকাটা গ্রামের কৃষকদের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে তাঁদের অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও কঠোর পরিশ্রম। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই কৃষি বিপ্লব পুরোপুরি কৃষকদের নিজস্ব প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের ফল।
 

 

কৃষক নজরুল হক

তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এত বৃহৎ পরিসরে আখ  চাষ হওয়া সত্ত্বেও এবং বহু পরিবার এতে যুক্ত থাকলেও, শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কৃষি বা সেচ দপ্তরের কোনো সরকারি প্রকল্প বা সুবিধা তারা পাননি। তবুও নিজেদের পরিশ্রম ও সৃজনশীলতার জোরে এই কৃষকরা স্বনির্ভর হয়ে শুধু নিজেদের পরিবার চালাচ্ছেন না, বরং গোটা অঞ্চলে এক অর্থনৈতিক বিপ্লবের সূচনা করেছেন।

মাদৈকাটা গ্রামের এই কৃষি বিপ্লব শুধুমাত্র স্থানীয় কৃষকদের জন্যই নয়, বরং সমগ্র আসামের কৃষকদের জন্যও এক অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে। প্রলয়ংকরী বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জীবিকা পুনর্গঠনের এই গ্রামের কাহিনি প্রমাণ করে  চ্যালেঞ্জের মধ্যেও সঠিক দিশা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে মানুষ সফলতা অর্জন করতে পারে।

বর্তমানে এই অঞ্চলের আখ  অসমের বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়াও ভুটানের বাজারেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যা কৃষকদের অধিক মুনাফা এনে দিচ্ছে। মাদৈকাটা গ্রামের আখ  চাষের এই বিপ্লব কৃষিক্ষেত্রে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে।