মুন্নী বেগম, গুয়াহাটিঃ
প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকেই সৌন্দর্যচর্চার জন্য প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিন্তু আধুনিক ব্যস্ত জীবনে সেইসব উপাদান সংগ্রহ করে রূপচর্চার উপযোগী করে তোলা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। তাই আজকাল বাজারে সহজলভ্য,কিন্তু রাসায়নিক মিশ্রিত প্রসাধন সামগ্রীর ব্যবহার ব্যাপক হারে বেড়েছে। এই অবস্থায় এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন গুয়াহাটির ইসলামপুর নিবাসী বিউটিশিয়ান ও মেকআপ আর্টিস্ট জেরিনা খাতুন। তিনি সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদানে প্রস্তুত প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করে গ্রাহকদের সৌন্দর্য বজায় রাখার পরিসেবা দিয়ে চলছেন।
‘আওয়াজ – দ্য ভয়েস অসম’-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জেরিনা খাতুন বলেন,“আমি গত ছয় বছর ধরে সৌন্দর্যসেবার কাজ করছি। পার্টি মেকআপ,ব্রাইডাল মেকআপ,অফিস লুক মেকআপ,প্রাকৃতিক উপাদানে ফেশিয়াল,হেয়ার ট্রিটমেন্ট সব ধরনের সৌন্দর্যসেবা দিয়ে আসছি। শুরুতে আমি বাড়িতে থেকেই বা গ্রাহকের বাড়িতে গিয়ে এই পরিষেবা দিতাম। কিন্তু প্রতিবার গ্রাহকের বাড়ি গিয়ে পরিষেবা দেওয়া সবসময় সম্ভব হয় না। তাই আমি ভাবলাম,যদি নিজের একটি পার্লার থাকে, তাহলে সবার কাছে সহজে পৌঁছাতে পারব। এই চিন্তা থেকেই আমি রিহাবারীর এ. কে. আজাদ রোডে ‘Glam & Grace’ নামের একটি লেডিস পার্লার শুরু করি।”
জেরিনা রুপচর্চার ছবিতে
বর্তমানে রূপচর্চার জন্য প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ উপাদান ঘরেই তৈরি করা বেশ সময়সাপেক্ষ ও ঝামেলাপূর্ণ। কারণ,প্রাকৃতিক প্রসাধন তৈরির প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ ও ধৈর্যের ব্যাপার। তাই বেশিরভাগ মানুষ সহজলভ্য ও সস্তা মূল্যের বাজারচলতি প্রসাধন ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু এসব প্রসাধন দীর্ঘদিন সংরক্ষণযোগ্য করে তোলার জন্য এতে নানা ধরনের রাসায়নিক মেশানো হয়,যা আমাদের চামড়া ও চুলের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
গুয়াহাটির ইছলামপুর নিবাসী বিউটিশিয়ান জেরিনা খাতুন এক ব্যতিক্রমী উদাহরণ। তিনি সম্পূর্ণ ঘরোয়া উপাদানে তৈরি, জৈবিক,প্যারাবেন ও সালফেট মুক্ত প্রসাধন ব্যবহার করে সৌন্দর্যসেবা দিয়ে চলেছেন।
জেরিনা খাতুন বলেন,“আমি সম্পূর্ণ ঘরোয়া উপাদানে তৈরি প্রসাধন ও তেল ব্যবহার করে গ্রাহকের চুল ও ত্বকের যত্ন নিই। আমার অনেক গ্রাহকই এতে উপকার পেয়েছেন। সৌন্দর্যচর্চায় প্রাকৃতিক প্রসাধনের দিকে যাওয়ার পেছনে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে।”
তিনি জানান,“একবার আমি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হই। সুস্থ হওয়ার পর মুখে ছোট ছোট দানার মতো গুটি উঠে এবং দাগ থেকে যায়। অনেক নামীদামি বাজারের ফেস ক্রিম ও সিরাম ব্যবহার করেও কোনো উপকার পাইনি,বরং দাগগুলো আরও ঘন হয়ে উঠেছিল। তখন থেকেই আমি ঘরোয়া উপাদান যেমন বিট, হলুদ,চালকুঁড়ি,নিমপাতা,ভিটামিন ই-যুক্ত উপাদান,দুধ,দৈ, বেসন,মসুর ডাল,মুলতানি মাটি,লিকোরিস পাউডার,চন্দন গুঁড়ো,গুলাব জল ও গুলাবের পাতা দিয়ে ফেস প্যাক,ক্রিম ও সিরাম তৈরি করে ব্যবহার করি। এক মাসের মধ্যে এর সুফলও পাই।”
তিনি আরও বলেন,“আমি যেসব উপাদানে নিজে উপকার পেয়েছি,সেগুলোরই এখন আমার গ্রাহকদের জন্য ব্যবহার করি। একইভাবে,চুলের যত্নেও আমি ঘরে তৈরি প্রাকৃতিক তেল ব্যবহার করে চিকিৎসা দিয়ে থাকি,যার খরচ বাজারের নামীদামি সামগ্রীর তুলনায় অনেক কম।”জেরিনা জানান,“আমার এখানে ফেসিয়াল মাত্র ৬০০ টাকায়,ক্লিনআপ ৩০০-৩৫০ টাকায় করা যায়।”
জেরিনা খাতুন: আত্মসম্মান ও স্বপ্নের সংগ্রামে এক অনন্য পথচলা।
একজন সফল বিউটিশিয়ান হবার পাশাপাশি জেরিনা খাতুন এখন ক্ষুদ্ৰ উদ্যোগের মাধ্যমে সমাজে নিজের পরিচয় গড়ে তুলেছেন। সৌন্দর্যসেবা কুটির শিল্পর মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতার দিকে এগিয়ে যাছেন।
জেরিনার পার্লারের ছবি
জেরিনা বলেন,"ছোটবেলা থেকে আমার স্বপ্ন ছিল দক্ষ একজন আইনজীবী হওয়ার। কিন্তু আমার পরিবারে পড়াশোনার থেকে বিয়েকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। আমার স্বামীর পরিবার বলেছিল,বিয়ের পরেও আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারব। সেই বিশ্বাসেই ২০০৬ সালে,মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের পরেই আমার বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে,বিয়ের পর আর পড়া চালিয়ে যেতে পারিনি।"
"একজন গৃহিণী হিসেবে স্বামী,সন্তান ও পরিবারের দায়িত্বই আমার একমাত্র ভূমিকা হয়ে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে চারপাশ থেকে শুনতে হয়,'বিয়ের পর পড়ে আর কী হবে?' কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। অন্তরে কিছু একটা করার তীব্র ইচ্ছা আগলে রেখেছিলাম। কারণ,আমি শুধু একজন গৃহিণী হয়েই বাঁচতে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম নিজের একটা স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তুলতে।"
জেরিনা আরও বলেন,"আমি ইউটিউব দেখে সেলাই শেখা শুরু করি। প্রথমে কিছুটা অসুবিধা হলেও আমার মামা,যিনি একজন দর্জি,তিনি আমাকে অনেক সাহায্য করেন। এরপর আমি ধীরে ধীরে ফ্রক,সালোয়ার স্যুট,গাউন ইত্যাদি সেলাই করে গ্রাহকদের জোগান দিতে শুরু করি।"
"বর্তমানে আমি সব ধরনের লেটেস্ট ডিজাইনের ফ্রক,সালোয়ার স্যুট,গাউন সেলাই করি এবং 'নেহাল ব্রাদার্স'নামে আমার কাপড়ের ব্র্যান্ডের মাধ্যমে সেগুলো গ্রাহকদের সরবরাহ করছি।"
“নিজের ধর্মীয়তা বজায় রেখে সফল হওয়া সম্ভব”জেরিনা খাতুনের আত্মবিশ্বাসী পথচলা
ইসলামে মহিলাদের অত্যন্ত সম্মানজনক স্থান প্রদান করেছে। নারীর শিক্ষা, ক্ষমতায়ন, অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে ইসলামে বারবার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। তবুও আজকের এই বৈজ্ঞানিক যুগেও মুসলিম সমাজের একাংশ এখনও মহিলাকে শুধুমাত্র ঘরের চারদেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়।
কিন্তু জেরিনা খাতুন মনে করেন, নিজের ধর্মীয়তা, শালীনতা বজায় রেখে এবং সমাজের নিয়ম না লঙ্ঘন করে,একজন মহিলাকে নিঃস্বার্থভাবে নিজের কাজে মনোযোগী হলে সফলতা অর্জন সম্ভব।
জেরিনা বলেন,"প্রথমে আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে সৌন্দর্যসেবার কাজ করতাম। পরে নিজের একটি বিউটি পার্লার শুরু করি। কিন্তু এই পদক্ষেপে আমার মা ছাড়া পরিবারের আর কেউ আমাকে সমর্থন করেনি। সবাই বলেছিল,যা করার সব ঘরে বসেই করতে হবে বাইরে গিয়ে নয়।"
"কিন্তু আমি জানি,ইসলামে মহিলাকে উচ্চ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা, ক্ষমতায়ন এই সব বিষয়ে ইসলাম সদা সচেতন। অথচ বর্তমান বৈজ্ঞানিক যুগেও সমাজের একটি অংশ মহিলাকে চুপচাপ গৃহবন্দি রাখতে চায়।"
"আজকের দিনে,যখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ চলছে,তখন ঘরে বসে শুধু ব্যবসা বাড়ানো একেবারেই সম্ভব নয়। তাই আমি পরিবারের অনেকের মতের বিরোধিতা করেই আমার পার্লারটি শুরু করি।"
"আমার খারাপ লাগে, আমি এখনও এই লড়াইয়ে একা লড়ছি। কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী যে,একদিন আমি সফল হব, এবং সবাই আমার প্রশংসা করবে। আমি আমার ধর্মীয়তা,শালীনতা বজায় রেখেই, কারও নিয়ম ভাঙা ছাড়াই, শুধুই নিজের কাজের মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যাব। এটাই ভবিষ্যতে আমাকে সফলতার দিকে নিয়ে যাবে।"
নারীদের সঠিক সমর্থন পেলে তারাও অনেক কিছু করতে পারে” জেরিনা খাতুন বিশ্বাস করেন।আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই কোনও না কোনও প্রতিভা লুকিয়ে থাকে। কিন্তু কেউ সেই প্রতিভাকে বিকাশের সুযোগ ও সমর্থন পায়, তাই সফল হয়। আবার কেউ পায় না বলেই সফলতা অধরাই থেকে যায়। কারণ, আজও সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা মহিলা, বিশেষ করে যুবতীদের খুব কম সমর্থন করে।
জেরিনা খাতুন মনে করেন,"মহিলা বা যুবতী যদি নিজের কাজের জন্য ঘরের বাইরে বের হয়,সেটি কোনও অপরাধ নয়। যদি নিজের পথ সৎ ও সঠিক হয়,তাহলে কেউ তাকে ক্ষতি করতে পারবে না।"
তাঁর কথাতেই উঠে এসেছে সমাজ বাস্তবতার এক নির্মম চিত্র,"আমাদের মুসলিম সমাজের একাংশ এখনও মেয়েদের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ নিয়ে সংকীর্ণ মানসিকতায় ভোগে। এমন অনেক অভিভাবক রয়েছেন, যারা মনে করেন মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলেই তাদের দায়িত্ব শেষ। অন্যদিকে, বহু পুরুষও আছেন যারা ভাবেন, একজন মহলা ঘরের বাইরে গেলে যেন কোনও অপরাধ করতে যাচ্ছে।"
"কিন্তু আমি বলি,যদি কেউ সৎ এবং সঠিক পথে থাকে, তাহলে অন্য কেউ কিভাবে তার ক্ষতি করতে পারে? আমাদের সবার মধ্যেই কোনও না কোনও প্রতিভা লুকিয়ে থাকে। কেবল প্রয়োজন সুযোগ আর কিছু সমর্থনের।"
জেরিনা বিশ্বাস করেন,"মেয়েরা অত্যন্ত প্রতিভাবান হয়। তাদের শুধু একটু সমর্থন ও যত্ন দরকার। তাহলেই তারা অসাধারণ কিছু করে দেখাতে পারে।"
জেরিনার মেহেন্দির ডিজাইন
জেরিনার ব্যবসায়ের মাত্রা কেবল সৌন্দর্যে সীমাবদ্ধ নয়। মেকআপ ও সেলাইয়ের জগতের বাইরে, তার বহু মহিলাকে শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য প্রদান করার পাশাপাশি স্বাবলম্বী হওয়ার পথ থেকে এক নতুন জীবনের শুরু দিয়েছে। শতাধিক যুবতীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করে তাদের আত্মনির্ভরশীল এবং স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখিয়েছে।
জেরিনা তাদের থেকে কোনো ধরনের অতিরিক্ত আর্থিক লাভ না নেওয়ার কথা উল্লেখ করেছে। অন্যদিকে, অর্থ-সম্পত্তির অভাবের কারণে আর্থিকভাবে দুর্বল যুবতীদের তিনি বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করে আসছেন। এই প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, যুবতীদের তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা চিনতে সাহায্য করা, যাতে তারা নিজেদের সাফল্যের দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
জেরিনা খাতুনের মতে,"আমি একটা কথাই ভাবি যে, যুবতীদের আত্মনির্ভরশীল হতে হবে। আর আমার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে, কেউ না কেউ আত্মনির্ভরশীল হতে পারবে।"
তার এই দৃষ্টিভঙ্গি এবং সহানুভূতি বহু যুবতীকে আত্মবিশ্বাসী এবং সংগঠিত হতে অনুপ্রাণিত করেছে, তারা নিজেদের জন্য এক সুস্থ, সাফল্য নিয়ে পরিবার গঠন করতে পারে।