ইমতিয়াজ আহমেদ ও আরিফুল ইসলাম / লংকা
সাধারণভাবে হোজাই জেলাকে সবাই চেনে আগরু কাঠের ব্যবসার জন্য।কিন্তু এখানকার অন্যান্য উদ্যোক্তারাও কোনো অংশে পিছিয়ে নেই।হোজাই জেলার লংকার উদালি তিনিআলি বাজারের পাশে, জাতীয় সড়কের দুই ধারে বহু স্থানীয় মানুষ নার্সারির ব্যবসা করে শুধু নিজেদের স্বনির্ভরই করেননি, বরং অনেক পরিবারকে রোজগারের সুযোগও করে দিয়েছেন।হোজাই থেকে কার্বি আংলং এবং ডিমা হাসাও-এর দিকে যাওয়া জাতীয় সড়কের পাশে বর্তমানে প্রায় ৬৫টি নার্সারি রয়েছে।এই নার্সারিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আলিয়া নার্সারি।
অনেক পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের ফল এইভাবেই ১০ বিঘা জমি জুড়ে আলিয়া নার্সারি রয়েছে ।এই নার্সারির পেছনে রয়েছেন এক পরিশ্রমী দম্পতি আলি আহমেদ ও নাজিমা বেগম।পূর্বে মিকির পাহাড় ও পশ্চিমে জয়ন্তিয়া পাহাড় ঘেরা কম বৃষ্টির এই অঞ্চলে গড়ে ওঠা এই নার্সারিটি আজ ফল, ফুল, ভেষজ, বনজ ও দামী গাছের হাজারেরও বেশি প্রজাতির চারা উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত।আলি আহমেদ ও নাজিমা বেগম নিজেরা শুধু স্বনির্ভর নন, বরং তাঁদের আলিয়া নার্সারি আজ ১০-১২টি পরিবারের আয়ের উৎস হয়ে উঠেছে।
বিয়ের পর তাঁদের দাম্পত্যজীবন ছিল বেশ কষ্টের।তাদের মতোই এলাকার অধিকাংশ মানুষের জন্য দৈনন্দিন জীবন ছিল সংগ্রামে ভরা।আলি আহমেদ ছিলেন একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে না পারায়, নাজিমা বেগম একটি প্রাইভেট ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকতা করতেন।এরপর প্রায় ১৫ বছর আগে, তাঁরা বাড়ির সামনেই ছোট পরিসরে একটি নার্সারি শুরু করেন।আর আজ তাঁরাই ১০ বিঘা জমির একটি বড়সড় নার্সারির সফল মালিক।
নার্সারির শুরুর কথা বিস্তারিতভাবে বলতে গিয়ে নাজিমা বেগম বলেন:"বিয়ের সময় আমাদের শুরুটা ছিল খুবই সাধারণ। জীবিকা নির্বাহ করাটা আমাদের জন্য ছিল ভীষণ কঠিন। আমি শিক্ষকতা করেও ঠিকমতো আয় করতে পারতাম না, আর আমার স্বামীর ব্যবসাটাও ছিল ছোটখাটো। আমরা আমাদের বাড়ির বাগানে ছোট একটি নার্সারি শুরু করেছিলাম। ধীরে ধীরে সেই নার্সারিটি বড় হতে থাকে। তখন থেকেই আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।আমাদের এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কম হওয়াটা নার্সারি ব্যবসার জন্য একটা দারুণ অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। সেই কারণেই আমাদের নার্সারিটি দ্রুত বাড়তে থাকে। এখন আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা উৎপাদন ও বিক্রি করি।”
ডবকার আলিয়া নার্সারি
নাজিমা বেগম আরও বলেন:"আমাদের নার্সারিতে সব ধরণের উচ্চমান সম্পন্ন হাইব্রিড চারা গাছ পাওয়া যায়। এখানে এমন কোনো গাছ বা চারা নেই যা আমাদের সুনাম ক্ষুণ্ন করতে পারে।শুধু নিজের নার্সারির চারা নয়, আশেপাশের ছোট ছোট নার্সারিগুলোর উচ্চমানের উৎপাদিত গাছপালাও আমরা সংগ্রহ করি এবং বিক্রি করি।
আমাদের এখানে বিভিন্ন প্রকার ফলের গাছ যেমন—আপেল, আলফানোস আম, আখরোট, ড্রাগন ফ্রুট, আসল হাইব্রিড সুপারি (তামোল) এবং বিভিন্ন মূল্যবান গাছ যেমন—আগর কাঠ, ফুল ও ঋতুভিত্তিক ফুলের চারা পাওয়া যায়।আমরা মূলত পাইকারি ব্যবসা করি, আর সেই কারণেই আমাদের উৎপাদিত পণ্যগুলো অত্যন্ত উপযুক্ত এবং প্রতিযোগিতামূলক দামে বিক্রি করে থাকি।”
বাজার নিয়ে প্রশ্ন করা হলে আলী আহমেদ জানান,“আমাদের উৎপাদিত পণ্যের বেশিরভাগই অসমের বাইরে যায়। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় দক্ষিণ ভারত,পশ্চিমবঙ্গ এবং মহারাষ্ট্রে। এর পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রায় সব রাজ্য থেকে আমাদের কাছ থেকে অর্ডার আসে।যে একবার আমাদের নার্সারি থেকে চারা কেনে, সে আবার ফিরে আসে আরও বেশি পরিমাণে কেনার জন্য।”আশ্চর্যজনক আয় স্থানীয় নার্সারিগুলোর।অত্যন্ত কম বৃষ্টিপাত হওয়া সত্ত্বেও লংকার উদালি তিনিআলি এলাকার অধিকাংশ নার্সারির বার্ষিক আয় আপনাকে চমকে দিতে পারে।‘আওয়াজ – দ্যা ভয়েস’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আলী আহমেদ বলেন, “আমাদের এলাকার অধিকাংশ বড় নার্সারি বছরে এক কোটি টাকার বেশি ব্যবসা করে।”
তিনি জানান, “সারা দেশে সবসময় যে চারা গাছের চাহিদা সবচেয়ে বেশি, তা হলো আগর গাছ। আমাদের অঞ্চলের বড় নার্সারিগুলো মূলত আগর গাছের চারা বিক্রি করেই ভালো ব্যবসা করে।এই উদালি তিনিআলি বাজার এলাকায় ৬৫টিরও বেশি নার্সারির মধ্যে ‘আলিয়া নার্সারি’-র মতো প্রায় ১৫টি বড় নার্সারি রয়েছে।”
আলিয়া নার্সারির লেনদেন সম্পর্কে নাজিমা বেগম বলেন, “আমাদের গড় বার্ষিক লেনদেন প্রায় ৮০ লাখ টাকার কাছাকাছি হয়। তবে আয়ের পাশাপাশি আমাদের খরচও প্রচুর, কারণ আমরা কখনও মানের সঙ্গে আপস করি না। সেটাই আমাদের ব্যবসার মূলমন্ত্র।তার পাশাপাশি আমরা আমাদের শ্রমিকদের পরিবারগুলোর দেখাশোনা করি এবং স্থানীয় অনুষ্ঠান ও সামাজিক কাজে নিয়মিত অনুদানও দিয়ে থাকি। আমাদের এলাকার অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকেও বাঁচিয়ে রাখতে কিছু অনুদান দিতে হয়।”
আলিয়া নার্সারির চারা গাছ
মান বজায় রেখে গড়া সুনাম বজায় রাখা ।আলিয়া নার্সারি একমাত্র নয়—উদালি তিনিআলি বাজার এলাকার অন্যান্য নার্সারিগুলিও মান বজায় রেখে দেশজুড়ে একটি ভালো সুনাম তৈরি করেছে।নাজিমা বেগম বলেন, “আমাদের এখানে কৃষি বা উদ্যানপালন দফতরের পক্ষ থেকে কোনো বিশেষ সরকারি সুবিধা আমরা পাই না। স্থানীয় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা পুরোপুরি নিজেদের অভিজ্ঞতা ও পকেট থেকে বিনিয়োগ করেই এই ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।”
নাজিমা বেগমের মতে, উদালি তিনিআলি বাজারের নার্সারিগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের সমস্যা নেই। তিনি বলেন,"একেবারে নেই। আসলে আমরা সবাই একে অপরের উপর নির্ভরশীল। বড় নার্সারিগুলি সত্যিই ছোটগুলোর ব্যবসা পরিচালনায় সাহায্য করে। যেহেতু আমাদের অধিকাংশ উৎপাদিত সামগ্রী অন্য রাজ্যগুলোতে চলে যায়, আমরা ছোটদের তাদের উৎপাদিত সামগ্রী সংগ্রহ করে বড় বাজারে পাঠাতে সহায়তা করি। এইভাবে তারা বাজার নিয়ে চিন্তা না করলেও চলে।”এই সহযোগিতা ও পরস্পরের উপর নির্ভরশীলতা অঞ্চলটির ব্যবসায়িক পরিবেশকে আরও সুদৃঢ় করেছে এবং সবার জন্য সুবিধাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।