অনিকা মহেশ্বরী / নয়া দিল্লি
কেরালার কলামণ্ডলমের মঞ্চে ১৬ বছর বয়সী কিশোরী সাবরি-র পারফরম্যান্স কেরালার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক স্মরণীয় মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এই মুহূর্ত শুধু তার স্বপ্নপূরণের ঘটনা নয়, বরং রাজ্যের প্রায় এক শতাব্দী পুরনো এই বিখ্যাত শিল্প প্রতিষ্ঠানটির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। কলামণ্ডলমের মঞ্চে কথাকলি পরিবেশনকারী সাবরি হলেন প্রথম মুসলিম মহিলা।
বিজয়া দশমীর শুভক্ষণে পরিবেশিত এই পারফরম্যান্সকে সাবরি তার দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা বলে বর্ণনা করেছে। সে জানায়,"এটি ছিল একটি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। একটুও ভয় লাগেনি, কস্টিউমের ওজন একটু বেশি ছিল, তবে মঞ্চে ওঠার পর সব সহজ হয়ে গেল। নৃত্য আমার আবেগ।"
তার বাবা, ফটোগ্রাফার নাজিম আম্মা নিজ কন্যার এই সাফল্যে অত্যন্ত গর্বিত। সংবাদমাধ্যমের সামনে তিনি বলেন,"এটি আমাদের পরিবারের জন্য এক অত্যন্ত গর্বের এবং আনন্দের মুহূর্ত। সাবরি সেই স্বপ্ন পূরণ করেছে, যেটি সে ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছিল।"উল্লেখযোগ্য যে,১৯৩০ সালে কবি ভল্টাথল নারায়ণ মেনন ও মুকুন্দরাজা প্রতিষ্ঠিত কেরালা কালামণ্ডলম রাজ্যের প্রধান শাস্ত্রীয় শিল্পকেন্দ্র,যা দশকজুড়ে কথাকলি,মোহিনীআট্টম এবং কুডিয়াট্টম-এর মতো ঐতিহ্যবাহী নৃত্যকলার রূপকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।৯৫ বছরের ইতিহাসে,এই প্রতিষ্ঠান এই প্রথম একজন মুসলিম ছাত্রীকে কথাকলি শিক্ষার সুযোগ দিয়েছে এবং মঞ্চে পরিবেশনার অনুমতি দিয়েছে।
প্রশিক্ষকের সঙ্গে সাবরি
সাবরিকে এই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানোর কৃতিত্ব দেন বিখ্যাত কথাকলি গুরু কালামণ্ডলম গোপী, যিনি বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন । মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন মেয়েকেও এই শিল্প-পরম্পরার অংশ করা উচিত। গোপীই প্রথম সাবরিকে কথাকলির প্রাথমিক মুদ্রাগুলি শেখান। এরপর সাবরি কালামণ্ডলম অনিল কুমার-এর তত্ত্বাবধানে তিন বছর ধরে কথাকলি নৃত্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।
অনিল কুমার বলেন, “সাবরি খুব মনোযোগ ও নিষ্ঠার সঙ্গে শিখেছে। তার পরিবেশনে সেই আত্মনিবেদন স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। নিজের অরঙ্গেট্রামে (প্রথম মঞ্চপ্রবেশে)সে অসাধারণ পারফরম্যান্স উপস্থাপন করেছে।”
বৃহস্পতিবার রাতে প্রায় ৪০ মিনিট ধরে, সাবরি কৃষ্ণ-বেশে ‘পূরপ্পাড়ু’ রূপে অভিনয় করে। এটি কথাকলির সূচনাংশ, যেখানে দর্শক প্রথমবারের মতো ভগবান কৃষ্ণের দর্শন পায়।নীল রঙের মুখমণ্ডল,বিশাল পোশাক পরে এবং ডোল ও চেন্ডা-র তালে যখন সাবরি মঞ্চে প্রবেশ করে,দর্শকগণ তাকে করতালির মাধ্যমে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায়।
তার বাবা বলেন,প্রদর্শনীর আগে মেকআপ এবং সাজসজ্জায় অনেক সময় লেগেছিল। সন্ধ্যা ৮টার সময়, যখন সাবরি মঞ্চে প্রবেশ করে,তখন মঞ্চে ইতিহাস রচিত হয়। কারণ,কেরালার কালামণ্ডলমের মঞ্চে প্রথমবারের মতো কোনো অ-হিন্দু মেয়েই কথাকলি উপস্থাপন করল।
সাবরির আগে,কেরালার কালামণ্ডলম বহু প্রতিভাবান শিল্পী দিয়েছে,যেখানে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সাথে জড়িত কালামণ্ডলম জন এবং প্রসিদ্ধ মুসলিম কথাকলি গায়ক কালামণ্ডলম হায়দার আলীও অন্তর্ভুক্ত। হায়দার আলী তাঁর আধ্যাত্মিক কণ্ঠের মাধ্যমে কথাকলির সঙ্গীতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন এবং ধর্মের সীমানা অতিক্রম করে শিল্পের প্রতি নিবেদনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
সাবরির উপস্থাপনা সেই পরম্পরাই অব্যাহত রাখছে যেখানে কোনো ধর্মের পার্থক্য নেই, শুধুমাত্র সাধনা এবং সৌন্দর্য্য রয়েছে।নাজিম বলেন, ছোটবেলায় থেকেই সাবরি কথাকলির রঙ এবং আবেগের প্রতি আগ্রহী ছিল। তার পিতার সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ফটোগ্রাফি করতে গিয়ে তার শিল্পকলার প্রতি আগ্রহ জন্মে। যখন পিতা তাকে জিজ্ঞেস করেন, “কথাকলি শিখতে চাও?” তখন সাবরি সঙ্গে সঙ্গে ইতিবাচক উত্তর দেয়।
২০২১ সালে কেরালা কালামণ্ডলম প্রথমবারের মতো ছাত্রীদের জন্য তার দ্বার উন্মুক্ত করে।সেই সময় সাবরি ষষ্ঠ শ্রেণীতে ছিল, কিন্তু ভর্তি হওয়ার জন্য ন্যূনতম অষ্টম শ্রেণী থেকে শুরু করতে হতো। দুই বছর পর, ২০২৩ সালে সে আবেদন করে এবং গুরু কালামণ্ডলম গোপীর সাহায্যে ভর্তি হতে সক্ষম হয়।
আজ সাবরি কেরালা কালামণ্ডলমে তৃতীয় দলের ছাত্রীদের মধ্যে একজন এবং কথাকলির জটিল অধ্যায় শেখা চালিয়ে যাচ্ছে। তার এই সাফল্য শুধু তার ব্যক্তিগত বিজয় নয়,বরং এই বার্তাও দেয় যে শিল্প সবার জন্যই,ধর্ম,জাতি বা সম্প্রদায় যাই হোক না কেন।
সাবরির এই পরিবেশন শক্তিশালী করেছে ধারণাটি যে ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বৈচিত্র্য, সমতা ও সম্প্রীতির মাধ্যমে পূর্ণ হয়।
বৃহস্পতিবার, কেরালা কালামণ্ডলমের মঞ্চে যখন ১৬ বছর বয়সী মুসলিম ছাত্রী সাবরি কৃষ্ণ বস্ত্র পরিধান করে নৃত্য করে, তখন তা শুধু একটি প্রদর্শনী ছিল না,এটি ছিল একটি কলার ঐতিহ্য ও সীমানা অতিক্রমের উদাহরণ।