জেব আখতার ঃ
ঝাড়খণ্ডের কোলাহান অঞ্চল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সমৃদ্ধ আদিবাসী সংস্কৃতির জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। কিন্তু এই দীপ্তিময়তার আড়ালে একটি কঠিন সত্য লুকিয়ে আছে। এই অঞ্চলের অন্তর্গত সরাইকেলা-খার্সোয়ান জেলা এখনও উন্নয়নের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে।
অর্থনৈতিক সংকট, শিক্ষার অভাব এবং নিয়োগের চ্যালেঞ্জ এখানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এই জেলার সীমানার কাছে কাপালি নামের একটি ছোট শহর আছে, যা জামশেদপুর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
জামশেদপুর পুরো দেশের শ্রমিক শ্রেণীর জন্য একটি বড় নিয়োগকেন্দ্র। বহু শ্রমিক এখানে এসে কাপালি শহরে থাকতে শুরু করেন, কারণ এখানে জীবনযাত্রা তুলনামূলকভাবে সস্তা। এদের অনেকেই জামশেদপুরে কাজ পান, তবে সেই কাজ স্থায়ী নয় অথবা সম্মানজনক উপার্জনও নয়। এর প্রভাব পড়ে তাদের সন্তানের শিক্ষার ক্ষেত্রেও।
ফলে, কাপালি ও আশেপাশের স্কুলগুলোতে স্কুলছাড়া শিক্ষার্থীর হার অত্যন্ত বেশি। এই সামাজিক বাস্তবতাই ছৈয়দ তারিক আলমকে নাড়া দেয়। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, যেকোনোভাবে এই পরিস্থিতি বদলাতে হবে। এই সংকল্প থেকেই আজ হাজার হাজার জীবনে আশার আলো পৌঁছেছে।
গত ১৩-১৪ বছর ধরে তারিক আলম এবং তাঁর সঙ্গী ছৌদ আলম, সাব্বির হোসেন, আদিল মালিক ও সরফরাজ আহমেদ দরিদ্র ও অভাবী শিশু ও পরিবারকে সাহায্য করে আসছেন।
ভাষণ দেওয়ার সময় সৈয়দ তারিক আলম
শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সহযোগিতার বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তাঁদের কাজ প্রশংসনীয় ও প্রেরণাদায়ক। তারিক আলম বিশ্বাস করেন, "সমাজকে পরিবর্তন করতে হলে শিশুদের থেকেই শুরু করা উচিত।" এই ভাবনা থেকেই তিনি কাপালিতে Ash Shamsh Anglo Urdu Middle School প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তিন বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলটি আজ তাদের জন্য আশার প্রতীক, যারা সন্তানদের পড়াতে চায় কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তা পারে না। বর্তমানে এখানে ৫৬ জন শিশুকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। বই, পোশাক, এবং পড়াশোনার পরিবেশ তাঁর ও তাঁর সহকর্মীদের ফাউন্ডেশন সরবরাহ করে।
স্কুলে ভর্তি প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত স্বচ্ছ। তারিক এবং তাঁর সহকর্মীরা নিজেরাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুর আর্থিক অবস্থা যাচাই করেন এবং পরে সিদ্ধান্ত নেন কার সত্যিকারের প্রয়োজন। কারণ, ফাউন্ডেশনের আয়ের কোনো বড় উৎস নেই—যা আসে নিজের পকেট থেকে বা বন্ধুদের সাহায্যে।
কিছু মানুষ বার্ষিক বা মাসিক ভিত্তিতে যতটা সম্ভব সহায়তা করেন। এর দ্বারাই শিক্ষকদের বেতন, শিশুদের বই, ইউনিফর্ম ইত্যাদির খরচ মেটানো হয়। তারিকের মতে স্কুলটি দু'টি ভাড়া করা ঘর থেকে শুরু হয়েছিল, এখন সেখানে চারটি ক্লাসরুম ও একটি ছোট অফিস আছে।
শুরু থেকেই তিনি ছাত্রীদের শিক্ষা নিয়ে আলাদা গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় গত ৫ বছরে ১,০০০-রও বেশি যুবতীকে বিনামূল্যে কম্পিউটার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। গরিব মেয়েদের স্বনির্ভর করে তুলতে এটি একটি বড় পদক্ষেপ।
তারিক আলমের স্কুলের শিক্ষার্থীরা
তারিকের বিশ্বাস, যদি মেয়েদের শিক্ষা ও প্রযুক্তি—দুটো দেওয়া যায়, তাহলে তারা একটি পরিবারের ভাগ্য বদলে দিতে পারে। শুধু তাই নয়, স্কুল থেকে উত্তীর্ণ অন্তত ৫ জন গরীব শিশুকে প্লাস টু স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে, যাতে তাদের শিক্ষা দশম বা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত গিয়ে না থেমে যায়।
তারিকের প্রচেষ্টা শুধু শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, কর্মসংস্থানকেও তিনি তার অভিযানের গুরত্বপূর্ণ অংশ করে তুলেছেন। বিদেশে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করে ফিরে এসে তিনি ঝাড়খণ্ডের কাপালি শহরে একটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন, যেখানে দরিদ্র যুবক-যুবতীদের বিনামূল্যে কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখনও পর্যন্ত ৩০০০-রও বেশি যুবক উপসাগরীয় দেশগুলোতে চাকরি পেয়েছে। এর ফলে তাঁদের পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি তো হয়েছে-ই, পাশাপাশি, তাঁদের সন্তানের পড়াশোনাও ঠিকভাবে চালিয়ে যেতে পারছে। এই উদ্যোগের বিশেষত্ব হলো উপসাগরীয় দেশগুলিতে থাকা তারিকের সহযোগীরা নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে কাপালির প্রশিক্ষিত যুবকদের অগ্রাধিকার দেন। এটি শুধু চাকরি সংক্রান্ত প্রতারণা ঠেকানোই নয়, বরং নিরাপদ ও স্থায়ী নিয়োগও নিশ্চিত করে।
তারিক আলমের স্কুলে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন
যে যুবক-যুবতীরা ভারতে থাকতে চায়, তাঁদের জন্যও ফাউন্ডেশন দেশের নানা জায়গায় চাকরির সুযোগ খুঁজেছেন। এ পর্যন্ত ৫০০-রও বেশি যুবক-যুবতীকে দেশের বিভিন্ন স্থানে চাকরি দেওয়া হয়েছে। তারিক আলম ও তাঁর সহযোগীরা সমাজের চাহিদা ব্যাপক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন।
উল্লেখযোগ্য, প্রধানমন্ত্রী যক্ষ্মা মুক্ত ভারত অভিযানের অধীনে তিনি ১০টি সাওর আদিবাসী পরিবারকে এক বছরের জন্য বিনামূল্যে রেশন দিয়েছেন। কোভিড-১৯-এর কঠিন সময়ে তিনি আইসোলেশন সেন্টার পরিচালনা করেছিলেন এবং টিকাকরণ অভিযান সফলভাবে বাস্তবায়িত করেছিলেন। গত ৭ বছর ধরে সৈয়দ তারিক আলম নিয়মিতভাবে স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির পরিচালনা করে বহু মানুষের জীবন বাঁচিয়েছেন। রমজান মাসে প্রতি বছর ৫০টি দরিদ্র পরিবারের মধ্যে রমজান কিট বিতরণ করেন।
এসব কার্যক্রম থেকে স্পষ্ট হয়, তারিক আলমের চিন্তাভাবনা কেবল শিক্ষা এবং চাকরির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানবতার সব মৌলিক চাহিদা পূরণ করাই তাঁদের লক্ষ্য। ২০১৪ সালে তারিক আলম ও তাঁর সহযোগীরা 'আলম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন' গঠন করেন। সমাজসেবার কাজ তিনি আগেও করতেন, তবে ফাউন্ডেশন হওয়ার পরে এই চেষ্টা আরও সংগঠিত ও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে।
আজ এই ফাউন্ডেশনের অধীনে স্কুল, কারিগরি প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য সামাজিক প্রকল্প চলছে। ফাউন্ডেশনের উদ্দেশ্য, ‘যেখানে প্রয়োজন, সেখানে সহায়তা করা।’ কাপালির মতো সীমিত সম্পদ, ক্ষুদ্র শহরে অন্যের জন্য কিছু করা সহজ ছিল না। তারিকের মতে, শুরুতে মূলধনের কোনো সংস্থান ছিল না, কিন্তু তিনি দমে যাননি। ধীরে ধীরে বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীরা তাঁকে সহযোগিতা করেছেন এবং এই যাত্রা এগিয়ে গেছে।
রক্তদান শিবিরে তারিক আলম
আজ, তারিক আলমের নাম কেবল কাপালি বা সরাইকেলা-খার্সোয়ান নয়, পুরো ঝাড়খণ্ডে এক অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে। সৈয়দ তারিক আলমের গল্প আমাদের শেখায়, সমাজ পরিবর্তনের জন্য সম্পদ বড় নয়, বড় উদ্দেশ্য থাকলেই হয়।
শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্য বা সামাজিক সহযোগিতা—সব ক্ষেত্রেই তারিক আলম প্রমাণ করেছেন, মানুষ চাইলে হাজার হাজার মানুষের জীবনে আলো নিয়ে আসতে পারেন। কাপালির এই গল্প শুধু ঝাড়খণ্ড নয়, পুরো দেশের জন্য অনুপ্রেরণা।