দৌলত রহমান, গুয়াহাটিঃ
মাত্র কয়েক বছর আগেও, যখন আফসানা বেগমের স্বামীর শারীরিক অবস্থা ভেঙে পড়ছিল, তখন এক সাধারণ গৃহবধূ এবং দুই সন্তানের স্নেহময়ী মা হিসেবে তাঁর জীবন এক গভীর মোড় নেয়। স্বামীর হাতে গড়া শূন্য থেকে শুরু করা ব্যবসার পুরো দায়িত্ব একদিন হঠাৎ করেই এসে পড়ে তাঁর কাঁধে।সেই জগত ছিল তাঁর জন্য একেবারেই অপরিচিত।ব্যবসা, সেইখানে পা রাখতে এবং শিখতে তাঁকে বাধ্য হতে হয়। জীবনের চ্যালেঞ্জ তখন রূপ নেয় এক নতুন অধ্যায়ে।
আজকের আফসানা বেগম শুধুই একজন মা বা গৃহবধূ নন,তিনি উত্তর-পূর্ব ভারতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় সফল মহিলা উদ্যোক্তা। তাঁর হাত ধরে গড়ে উঠেছে জনপ্রিয় অসমীয়া সংবাদপত্র "অসমীয়া খবব", অত্যাধুনিক শপিং মল, আন্তর্জাতিক রেস্টুরেন্ট চেইন "Pirates of Grill" এবং একাধিক রিয়েল এস্টেট ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প।
আফসানা বেগমের পরিবার
‘আওয়াজ - দ্য ভয়েস’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আফসানা বেগম জানান, তাঁর স্বামী শৈলেন কোঁয়র দত্ত ছিলেন একজন প্রতিভাবান এবং দূরদর্শী ব্যবসায়ী, যিনি একেবারে শূন্য থেকে নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। তবে, শরীরের অবনতির কারণে তিনি ধীরে ধীরে কর্মক্ষেত্র থেকে সরে আসতে বাধ্য হন।আর তখনই আফসানার জীবনে শুরু হয় এক নতুন সংগ্রামের গল্প।
“আমি হঠাৎ করেই ব্যবসার দায়িত্ব নিতে বাধ্য হই, আর এই জগৎটা আমার কাছে ছিল একেবারেই অচেনা,” আফসানা বেগম বলেন।“শুরুতে কিছুটা সংকটের মুখে পড়তে হয়েছিল। ব্যবসার মূল বিষয়গুলো বুঝতে ও শিখতে সময় লেগেছিল,কিন্তু ধীরে ধীরে সব কিছু গুছিয়ে উঠতে শুরু করি এবং ব্যবসার উপর আমার দখলও বাড়তে থাকে।”
আফসানা বেগমের মতে, নিজের একটি ব্যবসা শুরু করা কখনোই সহজ নয়, আর এগিয়ে যেতে হলে খারাপ সময়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকাটা জরুরি।তিনি বলেন, “আমরা কোভিডের আগে ‘O’ Guwahati’ নামে আমাদের নিজস্ব ব্র্যান্ডেড রেস্তোরাঁ চালাতাম। এক ছাদের নিচে ইন্ডিয়ান, চাইনিজ ও তন্দুরি খাবারের সেরা স্বাদের জন্য গুয়াহাটিবাসীর অন্যতম পছন্দ ছিল এই রেস্তোরাঁ। কিন্তু মহামারি যখন তীব্র আকার নেয়, তখন আমাদের বাধ্য হয়ে এটি বন্ধ করে দিতে হয়।”
পাইরেটস অফ গ্রিল-এর মতো বড় রেস্তোরাঁ
“শূন্য থেকে গড়ে তোলা একটা স্বপ্নকে থামিয়ে দেওয়া সহজ নয়,”তিনি বলেন। কিন্তু সেই সময় এটা ছিল অত্যাবশ্যক। তবে থেমে যাইনি। ২০২১ সালে আমরা নতুন করে শুরু করি এবং পাইরেটস অফ গ্রিল-এর মতো বড় ফ্র্যাঞ্চাইজি রেস্তোরাঁ গুয়াহাটিতে চালু করার সুযোগ পাই। অনেক পরিশ্রমের পর আজ আমি গর্বের সাথে বলতে পারি, এটি এখন গুয়াহাটির অন্যতম সেরা রেস্তোরাঁ।”
গুয়াহাটিতেই স্কুল এবং কলেজের পাঠ শেষ করা আফসানা বেগম মনে করেন, একজন মহিলার পক্ষে উদ্যোক্তা হওয়া যে খুব সহজ কাজ তা বলা যায় না। তবে অসম্ভবও নয়।
“আমার বাবা, প্রয়াত আব্দুল খালেক, গুয়াহাটি মাছখোয়া এলাকার একজন খাঁটি পরিশ্রমী ব্যবসায়ী ছিলেন,”—আফসানা বলেন—“আর সেই কারণেই ছোটবেলা থেকেই আমি ব্যবসার এক ইতিবাচক পরিবেশে বেড়ে উঠেছি। তবে,তা সত্ত্বেও একজন মহিলা হিসেবে সকলের আস্থা অর্জন করে কঠোর পরিশ্রমে নিজেকে প্রমাণ করা মোটেই সহজ ছিল না।”
“শূন্য থেকে একটি ব্যবসা দাঁড় করানো সবসময়ই একটি চ্যালেঞ্জ,যার জন্য প্রয়োজন হয় অটল ধৈর্য, আত্মবিশ্বাস আর নিরলস অধ্যবসায়।”
আফসানা বেগমের পুত্র দ্বয়
বর্তমানে আফসানা বেগম নিজের ব্যবসাকে আরও সম্প্রসারিত করার পথে এগিয়ে চলেছেন। তিনি এখন নিজস্ব একটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড গড়ে তুলতে বিনিয়োগ শুরু করেছেন। তাঁর লক্ষ্য গুণগত মানে একটুও আপস না করে অসমের মহিলাদের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে আকর্ষণীয় ও মানসম্পন্ন পোশাক সরবরাহ করা।
সফল উদ্যোক্তা হলেও আফসানা বেগম আজও একজন স্নেহময়ী মা ও যত্নশীলা গৃহবধূ এই দুটি পরিচয় তিনি গর্বের সঙ্গে বহন করেন। তাঁর বড় ছেলে এরিক জেভিয়ার একজন চিকিৎসক, আর ছোট ছেলে জিদান জেভিয়ার বর্তমানে নয়াদিল্লিতে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে এগিয়ে চলেছে।
পরিবারের সঙ্গে বর্তমানে দিল্লিতে বসবাস করলেও, আফসানা বেগম তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির জোরে আজও অসমে নিজ ব্যবসা সুচারুভাবে পরিচালনা করে চলেছেন।
একজন সফল মহিলা উদ্যোক্তা হওয়ার মূলমন্ত্র কী এই প্রশ্নে আফসানা দৃঢ়ভাবে বলেন,“নিজের সামর্থ্যে বিশ্বাস রাখতে হবে। নিজের উপর আস্থা না থাকলে কোনো লক্ষ্যেই পৌঁছানো যায় না। আপনাকেই বিশ্বাস করতে হবে আপনি পারবেন।”
“একটি শক্তিশালী সহায়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলুন,” উপদেশ দেন আফসানা বেগম।“এমন এক মহিলাদের সম্প্রদায় খুঁজে বের করুন, যারা আপনাকে পরামর্শ দিতে পারে, দিশা দেখাতে পারে এবং নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শেখাতে পারে। কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
“ব্যবসায় মনোনিবেশ করা সহজ, কিন্তু শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেওয়া ততটাই জরুরি। নিজের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে প্রতিটি দিক থেকে ভালোভাবে অবগত হওয়া উচিত।বাজেট, নগদ অর্থের প্রবাহ ও দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক পরিকল্পনার বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক। একজন আর্থিকভাবে শিক্ষিত নারীই প্রকৃতপক্ষে নিজের ব্যবসার প্রকৃত চাবিকাঠি নিজের হাতে রাখে।”
“আর সবচেয়ে বড় কথা,”আফসানা বেগম যোগ করেন,“আপনি যখন সফলতার পথে এগোবেন, তখন আপনাকে ভাবতে হবে কীভাবে অন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোক্তাদের বিশেষ করে মহিলাদের উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করা যায়।” আফসানা বেগম মানেই সাহস, সংকল্প আর সম্ভাবনার এক জীবন্ত নাম। তাঁর গল্প কেবল একজন মহিলার ব্যবসায়িক সাফল্যের নয়, এটা একজন স্ত্রীর, মায়ের, কন্যার এবং নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি, যা শত শত মহিলার জন্য পথপ্রদর্শক হয়ে উঠতে পারে।