দেবকিশোর চক্রবর্তী 
	
	
	তিনি কখনও ভারতের জার্সি গায়ে নামেননি। সুযোগ মেলেনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেকে প্রমাণের। অথচ আজ তাঁর নেতৃত্বেই ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল ইতিহাস লিখেছে — প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতেছে। বলাই যায়, এ এক অসমাপ্ত স্বপ্নের পূরণ, অন্য এক পথে। তিনি হলেন অমল অনিল মজুমদার, ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের প্রধান কোচ।
	
	
	মুম্বইয়ের এই প্রাক্তন ডানহাতি ব্যাটার ছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটের কিংবদন্তি। প্রায় আড়াই দশকের ক্যারিয়ারে রান করেছেন ১১,০০০-এরও বেশি, শতরান ৩০টির উপরে। রণজি ট্রফিতে রেকর্ড পরিমাণ ইনিংস খেলেও কখনও জাতীয় দলে সুযোগ পাননি। তাই এক সময় তাঁকে বলা হতো, “ভারতের সেরা অখেলানো ক্রিকেটার।”
	
	
	আজ সেই ‘অখেলানো’ ক্রিকেটারই ভারতীয় ক্রিকেটকে দিয়েছেন এক অবিস্মরণীয় ট্রফি। তাঁর তত্ত্বাবধানে মহিলা দল কেবল বিশ্বকাপই জেতেনি, বদলে দিয়েছে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের মানসিকতা, আত্মবিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি।
	
	
	‘চক দে ইন্ডিয়া’-র কবীর খান যেন বাস্তবে
	বিশ্বকাপের ট্রফি হাতে নারী ক্রিকেটারদের উচ্ছ্বাস দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় উথাল-পাথাল প্রতিক্রিয়া। নেটিজেনদের চোখে অমল এখন বাস্তবের ‘চক দে ইন্ডিয়া’ ছবির কবীর খান। সিনেমায় যেমন প্রাক্তন ক্রিকেটার ব্যর্থতার দাগ মুছে জাতীয় গৌরব ফিরিয়ে আনেন, বাস্তবেও অমল যেন সেই ভূমিকাই পালন করেছেন।
	
	
	একজন কোচ হিসেবে তাঁর কৌশল ছিল সরল অথচ গভীর। তিনি শুধু ব্যাট-বল শেখাননি, দলকে শিখিয়েছেন আত্মবিশ্বাসের ভাষা। প্রতিটি খেলোয়াড়ের সঙ্গে একান্তে কাজ করে তাঁদের মানসিক দৃঢ়তা বাড়িয়েছেন। “আমরা ছোটখাটো ভুলে হারতাম, এখন সেই ভুল থেকে শেখা শুরু করেছি,” বলেছেন অধিনায়িকা হরমনপ্রীত কৌর।
	
	
	ম্যাচের পর সংবাদ সম্মেলনে অমলের কণ্ঠে ছিল আবেগ। “এই জয়ের কৃতিত্ব আমার নয়, পুরো দলের। আমি শুধু ওদের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলেছি,”— বলেন তিনি। তাঁর এই সংযত মন্তব্যের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষার গর্ব।
	
	
	একদা নির্বাচকদের উপেক্ষা তাঁর মনোবল ভেঙে দিতে পারত। কিন্তু অমল বেছে নিয়েছিলেন অন্য পথ— ক্রিকেট ছেড়ে না দিয়ে, ক্রিকেট শেখানো। দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি গড়ে তোলেন এক আধুনিক, তথ্যভিত্তিক কোচিং পদ্ধতি। সেটিই আজ ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের সাফল্যের ভিত্তি।
	
	
	এই জয় কেবল একটি ট্রফির গল্প নয়; এটি ভারতীয় নারী ক্রিকেটের মানসিক মুক্তির প্রতীক। দেশের মেয়েরা এখন জানে, তাঁদের দক্ষতায় বিশ্ব জেতা সম্ভব। আর সেই বিশ্বাসের বীজ বপন করেছিলেন অমল মজুমদার।
	
	
	প্রাক্তন ভারতীয় অধিনায়ক সোরভ গাঙ্গুলি মন্তব্য করেছেন, “অমল সবসময়ই ক্রিকেটের ছাত্র ছিল। ওর চোখে খেলার যে বিশ্লেষণী দৃষ্টি, সেটাই আজ ফল দিচ্ছে। ভারতীয় ক্রিকেট অমলের কাছে ঋণী।”
	
	
	বিশ্বকাপ জয়ের পর, মুম্বইয়ের ছোট্ট ফ্ল্যাটে অমলের মা-ও নাকি টিভির সামনে কেঁদে ফেলেছেন। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেন, “ছেলেটা ছোটবেলা থেকে শুধু ক্রিকেট দেখেছে, ক্রিকেট ভেবেছে। আজ ওর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।”
	
	
	ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের এই সাফল্য অমলের পথচলার শেষ নয়, বরং নতুন সূচনা। সামনে রয়েছে আরও বড় চ্যালেঞ্জ — ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, আরও নতুন প্রতিভা গড়ে তোলা।
	যে মানুষটি একদিন নিজের নামের পাশে ‘ভারত’ শব্দটি লিখতে পারেননি, তিনি আজ পুরো দেশকে গর্বিত করেছেন। ক্রিকেটের ইতিহাসে এমন উলটপালটা গল্প খুব বেশি নেই।
	
	
	এ যেন এক অসমাপ্ত অধ্যায়ের মহিমান্বিত পরিসমাপ্তি —অমল মজুমদার: এক অখেলানো ক্রিকেটারের জয়, এক জাতির গৌরব।