এম হাফিজ আলি কেন একজন ব্যতিক্রমী শিক্ষক

Story by  Ariful Islam | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 8 d ago
এম হাফিজ আলি
এম হাফিজ আলি
 
আরিফুল ইসলাম / গুয়াহাটি

শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা, যা অন্য যেকোনো পেশার মতোই ভালোবাসা ও সম্মানের যোগ্য। এক কথায় বললে, শিক্ষকতার মতো মহান পেশা আর কিছুই নেই। একজন শিক্ষক যেমন একটি সমাজ বা দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলেন, ঠিক তেমনই দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অনেকাংশে শিক্ষকের ভূমিকার উপর নির্ভরশীল। সুতরাং দেখা যায়, শিক্ষকের কাঁধে থাকে দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের দায়িত্ব।এই রকম মহান পেশাকে সম্মানিত করেছেন এমনই একজন শিক্ষক, এম হাফিজ আলি। ছাত্রছাত্রীদের শুধুমাত্র শ্রেণিকক্ষের পাঠ্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, তাদের বৌদ্ধিক এবং মানসিক বিকাশের দিকেও নজর দেওয়ার জন্যই শিক্ষক এম হাফিজ আলি ব্যতিক্রমী।

পাঠদানের পাশাপাশি, মারৈ বিজুলীবাড়ি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হাফিজ আলির নেতৃত্বে শিক্ষক-শিক্ষিকারা ছাত্রছাত্রীদের বৌদ্ধিক ও মানসিক বিকাশের জন্য নানান উল্লেখযোগ্য কাজ করে আসছেন। এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যে রাজ্য এবং জেলা পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিজেদের দক্ষতা প্রদর্শন করে বহু পুরস্কার অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

শিক্ষক এম হাফিজ আলি বলেন, "শিক্ষক হতে গেলে তাকে সর্বজ্ঞানী হতে হবে এবং তার সব গুণ থাকতে হবে। যদিও আমরা সর্বজ্ঞানী হতে পারিনি, তবুও মহান শিক্ষকদের আদর্শে চলার চেষ্টা করতে হবে। শুধুমাত্র শ্রেণিকক্ষে অবস্থানকালে নয়, ২৪ ঘণ্টাই একজন শিক্ষক শিক্ষকই থাকেন। তিনি বিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমাজের শিক্ষক, পরিবারের শিক্ষক – সর্বত্র শিক্ষক হতে হবে। একজন শিক্ষককে শুধু নিজের নয়, সমাজকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমি যদিও সেই মহান শিক্ষকদের মতো অনেক কিছু করতে পারিনি, তবুও তাদের পথ অনুসরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি আমাদের বিদ্যালয়ে পাঠ্যপুস্তকের শিক্ষার পাশাপাশি শারীরিক, বৌদ্ধিক ও মানসিক বিকাশের উপর সবসময় গুরুত্ব দিয়ে থাকি। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমি ভবিষ্যতে কীভাবে এগিয়ে যেতে হবে, কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সমাজের জন্য সম্পদ হয়ে উঠতে হবে  এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করি। আমি মনে করি, একজন শিক্ষককে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর দেওয়া গেলেও, তিনি সারাজীবনের জন্য শিক্ষকই থেকে যান।"
 
শিক্ষক এম হাফিজ আলিকে সংবর্ধনা
 
২০১৯ সালে অসমভিত্তিক আয়োজিত 'Commemoration of 6th child protection Day'ত দরঙী লোকসংস্কৃতি বিশেষকরে নাঙলী গান প্ৰদৰ্শন করার জন্য বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা পুরস্কার লাভ করেছিল। ২০২৪ সালে 'Spreading Happiness India Foundation' সংক্ষেপে 'SHIF' নামের একটি বেসরকারী'NGO' আয়োজন করা 'মডেল প্ৰস্তুত করার প্ৰতিযোগিতাতে সমগ্ৰ দরং জেলার ভেতরে  বিদ্যালয়ের শিক্ষাৰ্থীরা  দ্বিতীয় স্থান পেতে সক্ষম হয়েছিল। তাছাড়া বিদ্যালয়ের শিক্ষাৰ্থীরা জেলাভিত্তিক বিভিন্ন ক্ৰীড়াতে নিজেদের পারদৰ্শিতা প্রমান করেছে। 


শিক্ষাদানের পাশাপাশি, বিদ্যালয়ে প্রতি শনিবার অনুষ্ঠিত হয় একটি বিশেষ অনুষ্ঠান  ‘শনিবারিয়া চরা’। এই অনুষ্ঠানটি ছাত্র-ছাত্রীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের প্রতিভা বিকাশের একটি সোনালি সুযোগ প্রদান করে। প্রতি শনিবার ছাত্র-ছাত্রীরা নৃত্য, আধুনিক গান, বিহু নৃত্য, জিকির গান, দরং আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ ‘নাঙলী’ গান, অভিনয়, বক্তৃতা, কুইজ এবং কারাটে ইত্যাদি পরিবেশন করে।

শিক্ষকতার  পাশাপাশি এম. হাফিজ আলি সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত একজন ব্যক্তি।বৃহত্তর বিজুলীবাড়ি অঞ্চলে তাঁর একটি স্বতন্ত্র পরিচিতি আছে। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে তাঁর উপস্থিতি সবসময়ই কাম্য। তিনি কলা-সংস্কৃতি, ক্রীড়া, সাহিত্য-সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সবসময় সক্রিয় থাকেন। একজন কৃতী শিক্ষক হিসেবে তিনি জাতীয় এবং রাজ্য পর্যায়ে একাধিক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন।
 

ছাত্র ছাত্রীদের সাথে শিক্ষক এম হাফিজ আলি
 
বর্তমানে তিনি ওদালগুড়ি জেলার কলাইগাঁওয়ের শিঙিরীমারী টাউনে ১৯৬৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল মরহুম হাকিম আলি এবং মার নাম মেমো বেগম। শৈশবে পিতৃহারা হয়ে তিনি ছিপাঝারের ঐতিহাসিক মারৈ গ্রামে মামার বাড়িতে থেকে স্কুলজীবন শুরু করেন এবং উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৯১ সালে শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত হয়ে বর্তমানে তিনি ছিপাঝারের মারৈবিজুলীবাড়ি উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। আগামী ২০২৬ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করবেন।

ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা করে আসা হাফিজ আলি বিগত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত।অসমের বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি নিবন্ধ ও প্রবন্ধ লিখে আসছেন। এছাড়াও বহু স্মৃতিগ্রন্থ ও স্মরণিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, মহাজীবন আজান ফকীর এবং বৰ্তমান গরীয়া জনগোষ্ঠীর সভ্যতা   সংস্কৃতি তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে, এম. রুস্তম আলীর জীবন এবং সৃষ্টি, অতুল চন্দ্ৰ দাসের - জীবন পথারত লেচেরি বুটলি, দরঙর লোকাচার বিশেষ, দরং জেলা সাহিত্য সভার সম্পাদিত পত্রিকা, ছিপাঝার প্রেসগিল্ডের স্মৃতিগ্রন্থ,
 মারৈ-বিজুলীবাড়ি বিদ্যালয়ের রূপালী জয়ন্তী স্মৃতিগ্রন্থ “মৌলি”, মারৈ জনশিক্ষা গ্রন্থালয় সোনালী জয়ন্তী স্মৃতিগ্রন্থ “মারৈ”,
 দরং জেলা প্রশাসনের ৫৬তম শিক্ষক দিবসের স্মৃতিগ্রন্থ, মারৈ বিজুলীবাড়ি সাহিত্য সভার রূপালী জয়ন্তী স্মৃতিগ্রন্থ “মাইহাং”, এম.বি. ক্লাবের স্মৃতিগ্রন্থ, বিদ্যালয়ের মুখপত্র, হাতে-লেখা আলোচনার তত্ত্বাবধায়ক, বহু স্মরণিকা ও শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রন্থ।
তিনি সাহিত্য একাডেমির আমন্ত্রণে গবেষণাপত্র পাঠ করেছেন। সাম্প্রতিককালে তিনি গরীয়া ওজা পরুশু-এর জীবনী অবলম্বনে উপন্যাস “উঁয়ে পোতা বলিশাল” প্রকাশ করেছেন।
 
কৃতি শিক্ষক হাফিজ আলি

হাফিজ আলির অর্জিত পুরস্কার গুলো:

 ২০১১: ভারতীয় দলিত সাহিত্য পরিষদের “ড. আম্বেদকর ফেলোশিপ” (জাতীয় পুরস্কার),
 ২০১২-১৩: ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের “সিনিয়র ফেলোশিপ”,
 ২০১৬: দরং জেলা প্রশাসনের জেলা ভিত্তিক “কৃতি শিক্ষক পুরস্কার”,
 ২০১৯: “আরোহণ সাহিত্য রত্ন পুরস্কার” (আরোহণ আর্টিস্ট গিল্ড, গুয়াহাটী),
 ২০১৯: “কবি সাহিত্যিক এম. ইব্রাহিম আলী স্মৃতি পুরস্কার” (গরীয়া যুব ছাত্ৰ পরিষদ),
 ২০২০: অসম সাহিত্য সভার শুয়ালকুছি অধিবেশনে সংবর্ধিত,
 ২০২১: অসম সরকারের “রাজ্যিক কৃতি শিক্ষক পুরস্কার”, অন্যান্য প্রায় কুড়িটি সামাজিক অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত।

বিদ্যালয় জীবন থেকেই সংগীতচর্চা করে আসা আলি একজন নিয়মিত জিকির শিল্পী (আকাশবাণী ও দূরদর্শন)।
তিনি নবম শ্রেণিতে থাকাকালীন ক্লাব ‘জেসমিন’-এর আয়োজিত নাট্য প্রতিযোগিতায় জেলার সেরা অভিনেতা হন। পরবর্তীকালে তিনি ‘কলাইগাঁও সংগীত নাটক’, ক্লাব জেসমিন ও নাট্যগোষ্ঠী “উদ্বাম্ব”-এর মাধ্যমে ২০টিরও বেশি নাটকে অভিনয় ও পরিচালনা করেন।

তিনি অভিনয় করেছেন, আচিফ ইকবালের “আজান ফকীর সাহেব”, আব্দুল মজিদের “সাত নম্বরর সন্ধানত” (অসমীয়া চলচ্চিত্র), ধারাবাহিক: “শুভ বিবাহ”, “স্বপ্ন ভংগ” (হিন্দি), স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র: “কাগজর ঘর”, “রশ্মী”, “কদম” (হিন্দি)।